ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ে মাওবাদীদের সঙ্গে এক অবস্থানে আপত্তি নেই সিপিএম-এর, তৃণমূল বলছে ওরা আদর্শহীন...
আজকাল | ১৪ মার্চ ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক পরিসর নিয়ে বারংবার বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে যাদবপুরে শিক্ষামন্ত্রীকে হেনস্থা করা ও সেই গোটা ঘটনাকে ঘিরে তোলপাড় হয়েছে দেশ। সেদিনের ঘটনা নিয়ে বিস্তর আলোচনা ইতিমধ্যে হয়েছে, কিন্তু গোড়ার যে বিষয়টি নিয়ে এত গোলমাল, সেই ক্যাম্পাসে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিষয়টি নিয়ে বরং রাজ্য়ের বাম রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে এক নতুন সমীকরণ। শেষ উপ-নির্বাচনে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে লড়তে দেখা গিয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট)-কে। এ বার কলেজে-কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে মাওবাদীদের সঙ্গে এক অবস্থান নিয়ে আপত্তি নেই সিপিএম-এর। ঘোষিতভাবে মাওবাদী রাজনীতির সমর্থক ছাত্র সংগঠন আরএসএফ-এর সঙ্গে পার্টি-লাইনের যোজন দূরত্ব থাকলেও এই ইস্যুতে এক পথে হাঁটতে আপত্তি করছে না কোনও দলই।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। যাদবপুর কাণ্ডের পর যেভাবে সিপিএমের তরফ থেকে আরএসএফ-এর সদস্যদের প্রতি পূর্ণ-সমর্থন জানানো হয়েছে, তাতে কলকাতা ও শহরতলিতে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন নকাশলপন্থী সংগঠনের প্রাক্তন ও বর্তমান সদস্যরা খুশিই হচ্ছেন। আড্ডায়-আলোচনায় উঠে আসছে এই পর্বে বাম যুব নেতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সৃজন ভট্টাচার্যের কথা। একদা প্রবল নকশাল বিরোধী সিপিএমের সৃজনের ভূমিকাকে বাম রাজনীতির ইতিহাসে এক যুগসন্ধীকালে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে। অনেকেই বলছেন, কবে মাওবাদীদের এত কাছাকাছি ঘেঁসতে শুরু করল সিপিএম? নাকি সবটাই ভেসে থাকবার চেষ্টা? কারণ, বাম আমলের শেষের দিকে এই নিয়ে অশান্তি-তো কম হয়নি।
যাদবপুরের ছাত্র রাজনীতির লাগাম আগাগোড়া অতিবাম সংগঠনের হাতে ছিল। বাম আমলের শুরু থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ক্ষমতাসীন ডিএসএফ-এর মূল চালিকাশক্তি ছিল পিডিএসএফ ও বেশ কিছু তৃতীয় ধারার বামপন্থী সংগঠন। সায়েন্সে পরবর্তীকালে ডাব্ল-টি-আই তৈরি হয়, সেখানেও অতিবামদের প্রভাব ছিল কিন্তু এই সংগঠন ছিল অনেকটাই ক্লাবের মতো। এই দুই বিভাগে অতিবামদের তেমন লড়তে হয়নি ক্ষমতায় থাকতে। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের চিত্রটা ছিল একেবারে অন্যরকম। সেখানে বিপুল ক্ষমতা নিয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিল সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই। কিন্তু বাম আমলের শেষের দিকে, যখন রাজ্য সরকারেরও জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়ছে, নানা দিক থেকে অশান্তির খবর আসছে, তখন ক্রমে, সেই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে জন্ম নেয় সিপিএম বিরোধী বামেদের যৌথ সংগঠন ফ্যাস। সেখানে প্রাথমিক ভাবে এআইএসএ (আইসা),ডিএসও থেকে শুরু করে মাওবাদী নকশালপন্থীরা ছিলেন।
এরপর বাম বিরোধিতার সুর চড়তে থাকে রাজ্য জুড়ে। শালবনির কারখানা থেকে শুরু করে নয়াচরের কেমিক্যাল হাব হয়ে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড়, সর্বত্র বামেদের একের পর এক নৃংশসতার নমুনা রাজ্যকে খেপিয়ে তোলে। তার সরাসরি প্রভাব এসে পড়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও। সেখানে তখন সম্মুখ সমরে সিপিএম ও তৃতীয় ধারার বামেরা। সেই লড়াই কিন্তু প্রাবল্যের নিরিখে কম কিছু নয়। বুদ্ধবাবুর আমলেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিরাট পুলিশবাহিনী ঢুকে বেধড়ক পিটিয়েছিল পড়ুয়াদের। লাইব্রেরির ভিতর ঢুকে পেটাতে-পেটাতে বার করে এনে ফেলেছিল মাঠে। শুধু তাই নয়, সরকারি ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন নেতারা ডিপার্টমেন্টে, হস্টেলে খেলাচ্ছলে হুমকি দেওয়া, বাড়ির ঠিকানা দিয়ে স্থানীয় সিপিএম নেতাকে পাঠিয়ে কোনও বিরোধী বামমনস্ক ছাত্রকে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর 'পরামর্শ' দেওয়ার মতো কাজ আজকের সিপিএমই অবলিলায় করেছে তখন। তখন, অন্যধারার বামকে চেতনার স্তরে এদের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করতেন এঁরা। তার একাধিক উদাহরণ মিলবে সংবাদপত্রের লাইব্রেরিতে কয়েকঘণ্টা কাটালেই।
কিন্তু, ইতিহাস যে বড়ই নির্মম। সেকালের শত্রুকে নিয়ে এ বার এক আসনে বসতে আর সমস্যা হচ্ছে না সিপিএমের, কারণ ভোটের রাজনীতিতে ইস্যু বড় বালাই। বাম নেতা সৃজন যদিও বলছেন, 'রাজনৈতিক মতাদর্শের দূরত্ব আছেই, থাকবেই। তাত্ত্বিক সেই দূরত্ব নিয়ে আলোচনা, তর্ক চলবে, সে দিক থেকে আপোষের প্রশ্নই আসে না। কিন্তু বর্তমানে ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র ফেরাতে, ছাত্রসংসদ নির্বাচন ফেরানোর ইস্যুতে আমরা ও আরএসএফ এক সমতলে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের দু'জনের দাবিই এক। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে অভিন্ন অবস্থান হতেই পারে। তীব্র তাত্ত্বিক ফারাক থাকলেও হতে পারে।'
রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র রাজর্ষী লাহিড়ি অবশ্য কোনও ইস্যুতেই বামেদের সঙ্গে ছাতায় আসতে রাজি নন। তিনি বলছেন, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে যাদবপুরের মতো ক্যাম্পাসে বাম-অতিবাম সংগঠনগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। উপাচার্যকে হত্যা করা হয়েছিল এই যাদবপুরের ক্যাম্পাসের ভিতরে। তার কালপ্রিটরা ধরা পড়েনি। ৭৭ সালে নকশালপন্থীদের ঘাড়ে পা রেখে ক্ষমতায় এসেছিল সিপিএম। এই আরএসএফ, এসএফআই এর মতো সংগঠনগুলো হল হল রাবনের দশটা মাথার মতো। এরা সকলেই হল এক। বিজেপি গোটা দেশের মতো এ রাজ্যেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ফেরানোর পক্ষে লড়বে। কিন্তু কখনই সেই লড়াইয়ে এই বামেদের সঙ্গে এক আসন ভাগ করার প্রশ্ন আসে না।
তৃণমূলের নেতা সুদীপ রাহা, তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গেও যিনি যুক্ত, তিনি আবার বলছেন, সিপিএম ও মাওবাদী ছাত্র সংগঠনের দীর্ঘ আঁতাতের কথা। তিনি স্পষ্টতই বলছেন, 'শূন্য় হয়ে যাওয়া পার্টির এ রাজ্য়ে আর কোনও স্থান নেই। এটা সিপিএম মানতে পারছে না। খড়কুটোর মতো বিভিন্ন সংগঠনকে এদিক-ওদিক থেকে ধরে এখন ভেসে থাকতে চেষ্টা করছে, এই রকমের রাজনৈতিক অবস্থান সেই দিকটি স্পষ্ট করে। এরা ক্ষমতার জন্য আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে পারে। বিজেপির সঙ্গেও এরা আঁতাত করেছে তৃণমূলকে পরাস্ত করতে, তাই ওদের এই অবস্থানে অবাক হওয়ার কিছু নেই।'
নৈহাটিতে লিবারেশনের সঙ্গে সিপিএমের জোট নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হলে প্রাক্তন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় আজকাল ডট ইন-কে বলেছিলেন, তিনি এই দুই মেরুর বামেদের ঐক্যের কথা, একসঙ্গে লড়াই করার কথা অনেকদিন ধরেই বলছেন, সে কথা আজ ফলে গেল। কিন্তু দেশজুড়ে বামেদের ক্রমে সংসদীয় গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাওয়া, আন্দোলনের ময়দানে তাঁদের ঝাঁঝ কমে যাওয়ার পর এমন ভোট কেন্দ্রীক সমঝোতা আদৌ কোনও প্রভাব ফেলবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ছিলই, ভোটবাক্সে তা স্পষ্ট হল। পাশাপাশি যে প্রশ্নগুলো থেকে যায়, তা হল, এই সিপিএম কি তা হলে মাওবাদীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে এবার থেকে নরম অবস্থান নেবে? নাকি কেবল আন্দোলনের বৈতরণী পেরিয়ে যেতে এই মাওবাদী সংগঠনগুলি কেবল মাত্র একটি পথ? নাকি, সত্যিই ভারতীয় বাম রাজনীতির শতবর্ষে দাঁড়িয়ে আবারও নতুন কোনও সমীকরণের ইঙ্গিত এই পরিস্থিতি। তাসখন্দে তৈরি হাওয়া পার্টি আজ শত টুকরো হলেও শেষ পর্যন্ত অসিত্ত্বের তাগিদে তারা আবারও এক ছাতার তলায় আসবে? রাজনীতির ছাত্ররা বোধহয় সেই 'বিরল যোগ'-এর অপেক্ষায় থাকবেন।