• এ শেয়ারড লিগ্যাসি' বইয়ের উদ্বোধনে...
    আজকাল | ১৫ মার্চ ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: সুন্দর নার্সারিতে বসন্তের উষ্ণ রোদে এক বিশেষ মুহূর্ত।  বাঙলার বস্ত্র ঐতিহ্য নতুন করে প্রাণ পেল 'টেক্সটাইলস ফ্রম বেঙ্গল: এ শেয়ারড লিগ্যাসি' বইয়ের উদ্বোধনে। মুজাফফর আলির 'জাহান-ই-খুসরু' বিশ্ব সুফি সঙ্গীত উৎসবের অংশ হিসেবে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছিল। এখানে জড়ো হয়েছিলেন বিদগ্ধ পণ্ডিত, বিখ্যাত ডিজাইনার এবং বস্ত্রপ্রেমীরা—যারা বাঙলার ঐতিহাসিক তাঁত শিল্পের নিখুঁত বুনন ও ইতিহাসের গভীরতা জানতে আগ্রহী ছিলেন।

    'টেক্সটাইলস ফ্রম বেঙ্গল: এ শেয়ারড লিগ্যাসি' কোনো সাধারণ নথিপত্র নয়—এটি একটি গভীর অনুসন্ধান বাঙলার বস্ত্রশিল্পের, ঔপনিবেশিকতায় বস্ত্রশিল্পের লড়াই, এবং তার টিকে থাকার গল্প। দুর্লভ চিত্রশিল্প ও সংরক্ষিত তথ্যের সাহায্যে বইটি তুলে ধরেছে বাঙলার তাঁত শিল্পের মহিমা এবং ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের কষ্টকর অধ্যায়গুলো।

    এই বইটি শুধু একটি ইতিহাস নয়, এটি একটি আহ্বান। আজকের যান্ত্রিক উৎপাদনের যুগে, বইটি পাঠকদের মনে করিয়ে দেয় যে বাঙলার বস্ত্র ঐতিহ্যের টিকে থাকা নির্ভর করে টেকসই উদ্যোগ এবং সাংস্কৃতিক মর্যাদার ওপর। বইটির অবদানকারী ও উইভার্স স্টুডিও রিসোর্স সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা দার্শন শাহ বলেন, "যদি আমরা আমাদের অতীতের তাঁতিদের স্বীকৃতি না দিই, তাহলে আমরা একটি ইতিহাস হারানোর ঝুঁকিতে আছি, যা আমাদের পরিচয় নির্ধারণ করে চলেছে।"

    বইটির আরেক অবদানকারী, ক্রাফট রিভাইভাল ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ঋতু শেঠি, এই কাজের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "বাঙলার বস্ত্র ঐতিহ্য এত প্রাচীন এবং এত সমৃদ্ধ, অথচ এ বিষয়ে গভীরভাবে গবেষণা করে এমন একটি বই ২০২৫ সালে এসে প্রকাশিত হচ্ছে, এটি সত্যিই আশ্চর্যের।"

    দার্শন শাহের বক্তব্যে উঠে আসে তার নৌপাড়া এবং কলনার ফিল্ড ভিজিটের অভিজ্ঞতা, যেখানে তিনি একজন জামদানি তাঁতিকে তাঁর শিল্পে নিমগ্ন দেখতে পান। তাঁতির হাতে কোনো নির্দিষ্ট নকশা বা গ্রাফ ছিল না, তবুও নিখুঁত নকশা তৈরি হচ্ছিল যেন স্মৃতির বুনন থেকে। শাহ তাঁতিকে তার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেন গানে—একটি 'গাণিতিক গান'। সেই গানেই লুকিয়ে ছিল নকশার গাণিতিক হিসাব, যা তাঁতির বুননের সাথে জড়িত।

    এই গান শুধু তাঁতের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়। চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়, বাঙলার গ্রামীণ নারীদের লোকগানের সংগ্রাহক, লিখেছেন, "আমি বাঙলার বিভিন্ন গ্রাম এবং আসামের গৌলপাড়া, শিলচর, করিমগঞ্জের শরণার্থী (পূর্ববঙ্গের) কলোনি থেকে এই গান সংগ্রহ করেছি।" এই গানগুলো বস্ত্রশিল্পের অদৃশ্য অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা বাঙলার তাঁত শিল্পের ঐতিহ্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

    বইটি শুধু অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, এটি সমকালীন সময়ের জরুরি প্রশ্নও তুলে ধরে। বাঙলার বস্ত্রশিল্প, যা একসময় এই অঞ্চলের প্রাণ ছিল, এখন আধুনিককালের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—শিল্পায়ন, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, এবং অবহেলা। বিশেষত নারীরা, যারা এই শিল্পের অদৃশ্য রক্ষক, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

    ঋতু শেঠি এ প্রসঙ্গে বলেন, "ভারতে বর্তমানে ৯৫ শতাংশ হ্যান্ডলুম তৈরি হয়, এবং বিশ্বব্যাপী যেকোনো হ্যান্ড এমব্রয়ডারি ভারতের মাটিতেই শুরু হয়েছে।" তিনি আরও বলেন, আমরা ধীরে ধীরে আমাদের বস্ত্রশিল্পের প্রতি সচেতন হচ্ছি, আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং দক্ষতা নিয়ে গর্বিত হচ্ছি। শহুরে বাজার যন্ত্রনির্মিত পোশাকে ভরলেও শিল্পী ও ডিজাইনারদের মধ্যে ভারতীয় বস্ত্রের প্রতি পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে।

    আলোচনা চলাকালে সমকালীন ফ্যাশনের প্রসঙ্গও উঠে আসে। বাঙলার হ্যান্ডলুম শিল্প শুধু জাদুঘরের প্রদর্শনীতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি বিখ্যাত ডিজাইনার সাব্যসাচী মুখোপাধ্যায়, রাজেশ প্রতাপ সিংহ, এবং পায়েল প্রতাপের সংগ্রহেও দেখা যায়। জামদানি, মসলিন, এবং কাঁথার কাজ এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। দর্শন শাহ উল্লেখ করেন, “গত ১৫-২০ বছর ধরে সমকালীন ডিজাইনাররা বাঙলার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিচ্ছেন।”

    বইটির গবেষণা সহজ ছিল না। পুরাতাত্ত্বিক নির্ভুলতা নিশ্চিত করা, নির্ভরযোগ্য উৎস খোঁজা, এবং আন্তর্জাতিক অবদানকারীদের সাথে কাজ করা—সবই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিল। তবে অনুষ্ঠানের উপস্থিতির সংখ্যা ছোট হলেও, আগ্রহ ছিল গভীর। দর্শন বলেন, "সংখ্যা কম ছিল, কিন্তু যারা এসেছিলেন তাঁরা অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন এবং বাঙলার বস্ত্রশিল্পের গভীর ইতিহাস সম্পর্কে জানার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন।"
  • Link to this news (আজকাল)