সঞ্জয় দে, শুশুনিয়া
রুক্ষ পাথরের বুকেও রয়েছে তাল এবং লয়, যদি তাকে বাঁধা যায় সুরে।
সেই অসাধ্য সাধন করেছে বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া গ্রামের যুবক অভীক কর্মকার। তার চেয়েও বড় বিষয়, দেশে তো বটেই, খুব সম্ভবত বাঁশির ইতিহাসে এই প্রথমবার পাথর দিয়ে তা তৈরি হলো। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, পেশাদার বাঁশি বাদকরাও যে কোনও অনুষ্ঠানে তা বাজাতে পারবেন।
বাঁকুড়া জেলা হস্তশিল্প মেলায় এই পাথরের বাঁশি তৈরি করে প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন অভীক। পরে ২০২৩-২৪ সালে কলকাতায় রাজ্য স্তরের হস্তশিল্প মেলা থেকেও প্রথম পুরস্কার ছিনিয়ে নেন তিনি। পাথর কুঁদে বিভিন্ন ধরনের মূর্তি এবং ঘরে সাজিয়ে রাখার মতো নানা ধরনের জিনিস তৈরিতে এমনিতেই সুনাম রয়েছে শুশুনিয়া গ্রামের। কিন্তু অভীকের আবিষ্কার রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। যেমন সুন্দর সুর ওঠে এই বাঁশিতে, তেমনই তার গড়নে রয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য। বাবা মানিক কর্মকার পাথর খোদাই শিল্পী হিসেবে ১৯৯৩ সালে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। সেইঐতিহ্য বজায় রেখে পুত্র পাথর খোদাইকে নিয়ে গিয়েছেন অন্য এক উচ্চতায়।
অভীক আবিষ্কৃত বাঁশির গড়ন অপূর্ব। সামনের অংশে রয়েছে হাতির মুখ-সহ শুঁড়। সারা গায়ে সুন্দর নকশা। কোন ভাবনা থেকে এই পাথরের বাঁশির জন্ম? অভীক বলছেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বাবার কাছে পাথর কেটে মূর্তি এবং বিভিন্ন ধরনের শো-পিস তৈরির তালিম নিয়েছি। তিন বছর আগে গ্রামের একটি মেলায় গিয়ে বাঁশের একটি বাঁশি কিনেছিলাম। বাঁশিটা দেখতে এত সুন্দর ছিল যে কিনেছিলাম সেটা।’
বাড়িতে ফেরার পরেই অভীকের মনে হয়, পাথর কেটেও কি বাঁশি তৈরি করা যায় না। শুরু হয়ে যায় কাজ। তিনি বলে চলেন, ‘একটা পাথরকে খোদাই করে তাকে বাঁশির আকার দিই। সচরাচর বাঁশিতে যেমন থাকে, সে ভাবেই ভিতরের দিক ফাঁপা রেখে সাতটি ছিদ্র এবং ফুঁ দেওয়ার জায়গায় একটি ছিদ্র তৈরি করি।’
ফুঁ দিতেই পাথরের বুক থেকে বেরিয়ে আসে সুর। কিন্তু তাকে আরও পরিষ্কার এবং শ্রুতিমুধুর করে তুলতে শুরু হয় বাঁশির ভিতরের দিক এবং ছিদ্রগুলিকে ঠিক মতো গ্রাইন্ডিং করা। সাড়ে তিন মাসের নিরলস পরিশ্রমের পরে আত্মপ্রকাশ পাথরের বাঁশির। শুরু হয় তার গায়ে নানা ধরনের নকশা তৈরির কাজ। অভীকের কথায়, ‘ওডিশা থেকে আনা পাথর দিয়ে এই বাঁশি তৈরি হয়েছে। জানি না, এর আগে পাথরের বাঁশি তৈরি হয়েছে কি না।’
বাঁকুড়া জেলা হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে পাথরের বাঁশি সকলের নজর কেড়ে নেওয়ার পরে লোকমুখে তার প্রচার ছড়িয়ে পড়ে নানা প্রান্তে। সম্প্রতি বাঁকুড়া জেলার বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত শিল্পী দীপ চট্টোপাধ্যায় চলে আসেন সেই বাঁশি দেখতে। তাঁরই ব্যান্ডের এক শিল্পী বাপ্পা ধীবর সেই বাঁশি বাজিয়ে বিস্মিত হয়ে যান, কী করে এমন সুর বেরোতে পারে! বাপ্পা বলছিলেন, ‘এ এক অসাধারণ সৃষ্টি।’ দীপ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘পাথরের তৈরি বাঁশি আগেও দেখেছি, তবে তা ঘরে সাজিয়ে রাখার। কিন্তু পাথরের বাঁশির বুক থেকে এমন সুন্দর সুর উঠে আসে, তা এই প্রথম দেখলাম। যে কোনও পেশাদার বংশীবাদক অনুষ্ঠানে এই বাঁশি বাজাতে পারেন।’ বিশিষ্ট বংশীবাদক সুবীর রায় বলছেন, ‘হাড়ের তৈরি বাঁশির ইতিহাস সৃষ্টির গোড়াতেই রয়েছে। ফলে পাথরের বাঁশি হতেই পারে। আমি ব্যবহার করিনি কিন্তু, ওই বাঁশিতে সুরও খেলতে পারে।’
কত দাম এই পাথরের বাঁশির? অভীক বলছেন, ‘এমন বাঁশির দাম পড়বে ৯০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা। কেউ অর্ডার দিলে বানিয়ে দিতে পারি। তবে নকশা একরকম হবে না।’ যদিও নিজের হাতে গড়া পাথরের এই বাঁশিটি কাউকে বিক্রি রাজি নন তিনি। তাঁর কথায়, ‘এই বাঁশি আমাকে স্বীকৃতি, সম্মান দিয়েছে। এটা বিক্রি করব না। এটা থাকবে আমার কাছেই।’