মানুষটির মাথার মাঝখান থেকে টেরিকাটা পাতলা চুল দু’পাশে ছড়ানো। ঈষৎ বড় একটা মাছি গোঁফ। কোট ও বাটারফ্লাই টাই পরিহিত সেই মানুষটির চোখ তখন ঘুরছে সিন্ধ প্রদেশের লারকানা জেলার প্রত্যন্ত রুক্ষ প্রান্তরে। সেটা ১৯২২ সাল। ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ শাসনাধীন। হঠাৎই তিনি একটি উঁচু ঢিবি দেখতে পেলেন। কৌতূহল হওয়ায় সেখানে খনন কাজ শুরু করলেন।
আর তার পরেই বেরিয়ে এল পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো মহেঞ্জোদারো সভ্যতার একের পর এক নিদর্শন। আধুনিক বিশ্বের দরবারে উন্মোচিত হলো তর্কযোগ্য ভাবে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা। যে ব্যক্তির হাত ধরে এই আবিষ্কার, তিনি বাঙালি পুরাতত্ত্ববিদ বনগাঁর ভূমিপুত্র রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সেই আবিষ্কারের শতবর্ষ পরে ফের এক বাঙালির হাত ধরে শুরু হলো হরপ্পা সভ্যতার খননকাজ।
গুজরাটের লুথালে সেই খননকাজের দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুরাতত্ত্ববিদ শুভ মজুমদার মনে পড়িয়ে দিলেন পরাধীন ভারতের বিস্মৃত নায়ক রাখালদাসকে। দিনকয়েক আগে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের ডিরেক্টর জেনারেল যদুবীর সিং রাওয়াত ও অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল জানহিজ শর্মার উপস্থিতিতে ওই খননকাজের সূচনা হয়।
হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার মূল অংশটি বর্তমানে পাকিস্তানের অধীনে থাকলেও এর বিস্তৃতি বহুদূর পর্যন্ত ছড়ানো ছিল। হরপ্পার দক্ষিণ অংশ রয়েছে বর্তমান ভারতের গুজরাট হয়ে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো গুজরাটের লুথাল (লোথাল)। স্বাধীনতার পরে ১৯৫৪-৫৫ সালে তৎকালীন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের ডিরেক্টর এসআর রাও-এর হাত ধরে প্রথম খননকাজ চলেছিল লুথালে।
তার ৭০ বছর পরে ফের ওই এলাকায় নতুন করে খনন শুরু করলেন শুভ। হরপ্পা সভ্যতায় লুথালের গুরুত্ব কোথায়? পুরাতত্ত্ববিদেরা জানাচ্ছেন, সেই সময় লুথাল ছিল বন্দর। এখান থেকেই বহির্বিশ্বে আমদানি-রপ্তানি হতো। এর কিছু দূরেই ছিল ভোগাভো নদী। সেই নদী থেকে চ্যানেল করে জল এনে চালানো হতো নৌকো। সেই নৌকোয় পণ্যসামগ্রী মূল নদী ও সমুদ্র পথে চলে যেত মেসোপটেমিয়ায়। ভারতীয় পুরাতত্ত্ববিদদের দাবি, লুথালই হলো বিশ্বের প্রথম বন্দর যেখানে ট্রেডিং হতো। তাঁরা আরও জানাচ্ছেন, পণ্য রাখার জন্য লুথালে বেশ কিছু ওয়ারহাউসেরও খোঁজ পাওয়া গিয়েছে।
৭০ বছর পরে ফের কেন লুথালে খননকাজ শুরু হলো? পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের সুপারিন্টেন্ডিং আর্কিয়োলজিস্ট ও লুথাল খননকার্জের ডিরেক্টর শুভ জানাচ্ছেন, ১৯৫৪ সালে যখন এখানে প্রথম খনন শুরু হয়েছিল তখন টেকনোলজি এত উন্নত ছিল না। অর্থাৎ খননপ্রাপ্ত সামগ্রীর অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা যায়নি।
উদাহরণ দিয়ে শুভ বলেন, ‘ওই সময়ের কিছু ফিশ বোন পাওয়া গিয়েছে যেগুলো তখন উন্নত প্রযুক্তিতে বিশ্লেষণ করা যায়নি। ওই মাছ মিষ্টি জলের না সমুদ্রের তার উপর তখনকার ভৌগোলিক চেহারাটা অনেক স্পষ্ট হবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তি সম্পর্কে ধারণা অনেক দৃঢ় হবে।’ এ ছাড়া ওই সভ্যতার আঞ্চলিক বৈচিত্র জানাও এই খননের উদ্দেশ্য বলে জানাচ্ছেন তিনি।
লুথালে নতুন করে খননকাজ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রূপেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, স্বচ্ছ ধারণা ও প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের সঙ্গে বাঙালি মন নিয়ে কাজ করেছিলেন রাখালদাস। তাঁর মতে, শুধু কিছু স্মারক সংগ্রহ নয়, এ ক্ষেত্রে একজন ইতিহাসবিদের মন নিয়ে পুরো বিষয়টিকে দেখতে হবে।
প্রবীণ এই পুরাতত্ত্ববিদ বলেন, ‘হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো ছড়িয়েছিল পাকিস্তান, বালুচিস্তান, আফগানিস্তান, ভারতের গুজরাট, রাজস্থানে। যা নিয়ে গড়ে উঠেছিল গ্রেটার ইন্দাস ভ্যালি সিভিলাইজেশন বা ইউনিভার্সাল হরপ্পা। এখানে সব অংশের মানুষের কনট্রিবিউশন ছিল। এখন সেই মানুষগুলোর জীবনচর্যা জানতে হবে। সমুদ্র উপকূলগোষ্ঠী, কৃষিজীবী মানুষের সংস্কৃতির পরম্পরা, বেড়ে ওঠার ইতিহাস যদি জানা যায়, তবে সেটাই হবে আসল আবিষ্কার।’
খনন চলছে। পুরাতত্ত্ববিদদের আশা, এক দিন প্রাচীনতম সভ্যতার নিতান্ত সাধারণ মানুষের জীবন কাহিনির বিস্তারিত তথ্যও উঠে আসবে আজকের টেকস্যাভি দুনিয়ায়।