• হিউম্যানিটিজ়ের ‘নোবেল’ পেলেন গায়ত্রী স্পিভাক
    এই সময় | ১৭ মার্চ ২০২৫
  • এই সময়: পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তুলনামূলক সাহিত্য, নিম্নবর্গের ইতিহাস, নারীবাদ, সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শন নিয়ে গবেষণা এবং অধ্যাপনার স্বীকৃতি হিসেবে নরওয়ের হলবার্গ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক।

    আর্টস ও হিউম্যানিটিজ়ের নোবেল বলে পরিচিত এই পুরস্কার আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গায়ত্রীর দীর্ঘ কেরিয়ারের অসংখ্য স্বীকৃতি ও সম্মানের মুকুটে অন্যতম পালক। গত ১৩ মার্চ গায়ত্রীর নাম ঘোষণা করলেও আগামী ৫ জুন নরওয়ের বেরজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে ওই পুরস্কার তাঁর হাতে তুলে দেবেন সে দেশের যুবরাজ হাকোন। পুরস্কারের অর্থমূল্য ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা।

    গায়ত্রীর নিজের কথায়, ‘শুধু মাত্র বিপুল পরিমাণ তথ্য ও জ্ঞান সঞ্চয় করা কখনও কোনও সুসংহত ও গণতান্ত্রিক সমাজের জন্ম দিতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার অভ্যাস।’ নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চাকে শুধুমাত্র থিয়োরির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি গায়ত্রী।

    নিম্নবর্গ ও প্রান্তিক মানুষ, বিশেষত প্রান্তিক মহিলাদের জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য ছোট ছোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন আজীবন। বীরভূমের রাজনগরের প্রত্যন্ত গ্রাম, পুরুলিয়ার শবর গ্রামেও নাম না জানা বহু স্কুলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছেন আধুনিক বিশ্বের জ্ঞানচর্চার শিখরে থাকা আলোকবর্ষী এই নারী। রণজিৎ গুহর নেতৃত্বে সাবঅলটার্ন স্টাডিজ়ের যে শাখা বিস্তৃত হয়েছে এ দেশে, আগাগোড়া তার সঙ্গেও ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন গায়ত্রী।

    প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী ৮২ বছর বয়সি গায়ত্রীর এই বিরল সম্মানে উচ্ছ্বসিত বাঙালি শিক্ষাবিদরাও। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ গৌতম ভদ্র এই খবর শোনার পর ‘এই সময়’কে বলেন, ‘গায়ত্রী খুবই বুদ্ধিমতী স্কলার। সারাজীবন ধরে পুরস্কারের মোহ ত্যাগ করেই গায়ত্রী কাজ করে গিয়েছেন।

    স্বীকৃতি তাঁর সেই কাজের জন্যই এসেছে। তাঁকে কখনও স্বীকৃতি বা পুরস্কারের পিছনে ছুটতে দেখিনি। ভালো লাগছে এ কথা ভেবে যে একজন যোগ্য মানুষের কাছেই এই স্বীকৃতি গিয়েছে।’ অ্যাডামাস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইতিহাসবিদ সুরঞ্জন দাস বলেন, ‘উনি বাঙালি মেয়ে। তাই বাঙালি হিসেবে আমি খুবই গর্বিত। ওঁর পোস্ট কলোনিয়াল লিটারেচার, ডিকনস্ট্রাকশন, কালচারাল স্টাডিজ় এবং ফেমিনিজ়মের উপরে অসাধারণ সব কাজ রয়েছে।’ ইতিহাসবিদ ও অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘এটা জেনে ভালো লাগছে যে যোগ্য একজন মানুষকেই এই স্বীকৃতির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে।’

    গায়ত্রীর এই পুরস্কার প্রাপ্তির খবরটি নিজেদের ওয়েবসাইটে বিরাট আকারে প্রকাশ করেছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও। ২০০৭ সাল থেকে আমেরিকার প্রিমিয়ার ওই ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করছেন বঙ্গকন্যা গায়ত্রী। কলম্বিয়ার ইনস্টিটিউট ফর কমপ্যারেটিভ লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।

    গায়ত্রীকে মনোনীত করার কারণ ব্যাখ্যা করে হলবার্গ কমিটির চেয়ারম্যান হাইকি ক্রিগার বলেন, ‘সমালোচনামূলক ব্যাখ্যার জন্য পাশ্চাত্য চিন্তার মূল ভাবনাকে গ্রহণ করেছেন স্পিভাক। কিন্তু তাঁর সমালোচনার অন্তরে রয়েছে ক্রমাগত প্রশ্ন করার অভ্যাস। আধুনিক বিশ্বের ভাবনার মূল কেন্দ্র ও প্রান্তসীমা, দু’টিকেই সমান ভাবে স্পর্শ করেছেন তিনি।’

    নিজেদের অফিশিয়াল বিবৃতিতে কলম্বিয়া জানিয়েছে, ‘আধুনিক পৃথিবীতে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্যদের মধ্যে গায়ত্রীর স্থান একেবারে প্রথম সারিতে।’ প্রতি বছর আর্টস, হিউম্যানিটিজ়ের বিভিন্ন শাখা, আইন, সোশ্যাল সায়েন্স এবং থিয়োলজি নিয়ে গবেষণা ও চর্চার স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দেয় নরওয়ের হলবার্গ কমিটি। নরওয়ে সরকারের এই পুরস্কার দেওয়া হয় বেরজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে।

    উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সাহিত্য, নারীবাদ, বিশ্বায়ন, পলিটিক্যাল থিয়োরি ও ক্রিটিক্যাল সোশ্যাল থিয়োরি নিয়ে গায়ত্রীর সারা জীবনের গবেষণা সারা পৃথিবীর অন্তত ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সারা বিশ্বের অন্তত ৫০টি দেশে অধ্যাপনার সুবাদে তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা ৯ হলেও, বিভিন্ন বিষয়ে গায়ত্রীর লিখিত অসংখ্য প্রবন্ধ সারা বিশ্বে পড়ানো হয়। তুলনামূলক সাহিত্য, অনুবাদ, পোস্ট কলোনিয়াল স্টাডিজ়, পলিটিক্যাল ফিলোজ়ফি এবং ফেমিনিস্ট থিয়োরি নিয়ে তাঁর সারা জীবনের কাজের সুবাদেই এই পুরস্কার বলে জানিয়েছে কলম্বিয়া।

    ফরাসি দার্শনিক জ়াঁক দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন থিয়োরির সঙ্গে ইংরেজিভাষী বিশ্বের পরিচয় ঘটানোরও অন্যতম কারিগর গায়ত্রী। তাঁর শ্রেষ্ঠ নিবন্ধ ‘ক্যান দ্য সাবঅলটার্ন স্পিক?’ পোস্ট কলোনিয়াল স্টাডিজ়ের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। ফ্রেঞ্চ হাই থিয়োরি থেকে শুরু করে ওই প্রবন্ধে তিনি এসে পৌঁছন ভারতের সতীদাহের প্রসঙ্গে। ভারতীয় সমাজে মেয়েদের নিজের স্বর, নিজের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকাকে তিনি জুড়ে দেন ফরাসি তত্ত্বের, আরও স্পষ্ট করে বললে পশ্চিমি দর্শনের দেখার সীমাবদ্ধতার সঙ্গে।

    ২০০৭ সাল থেকে প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা শুরু করলেও কলম্বিয়ার সঙ্গে গায়ত্রী যুক্ত ১৯৯১ সাল থেকে। কলম্বিয়ার ফ্যাকাল্টি অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ডিন অ্যামি হাঙ্গারফোর্ড বলেন, ‘প্রফেসর স্পিভাকের এই স্বীকৃতিতে আমরা অভিভূত। সাহিত্য, সমাজ, দর্শন এবং শিক্ষাকে বোঝার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আগামী অনেক প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে।’ সারা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তত ১৫টি সাম্মানিক ডক্টরেট পেয়েছেন গায়ত্রী। পেয়েছেন পদ্মভূষণ, কিয়োটো আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মতো অসংখ্য পুরস্কার।

  • Link to this news (এই সময়)