ভালোবাসার প্রমাণ চায় এই সিস্টেম। কাগুজে প্রমাণ। ভালোবাসার সম্পর্ক, একে অন্যের সহায় হওয়া, বছরের পর বছর একসঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকা, এ সব কিছু থাকলেই হবে না। সিস্টেমের কাছে ডকুমেন্ট–ই আসল কথা। অতএব একত্রবাসের সঙ্গিনী বা লিভ–ইন পার্টনার আচমকা অসুস্থ হয়ে মারা গেলে তাঁর দেহ পেতে ৪২ দিন ধরে সিস্টেমের বিভিন্ন দরজায় দরজায় ঘুরতে হয় তাঁর একত্রবাসের সঙ্গীকে। তাঁরা কাছে তো ভালোবাসার সম্পর্কের কাগুজে প্রমাণ নেই। সঙ্গিনীর দেহ তাই পড়ে থাকে লাশকাটা ঘরে।
দক্ষিণ শহরতলির গড়ফা এলাকার ওই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত সোমবার পদক্ষেপ করতে হলো কলকাতা হাইকোর্টকে। গড়ফার ঝিল রোডের একটি ভাড়াবাড়িতে রুদ্র ও মেঘা (দু’জনের নাম পরিবর্তিত) থাকছিলেন শেষ ১২ বছর। প্রায় মধ্যবয়সি ওই দু’জন তার আগেও একসঙ্গে থাকতেন অন্যত্র। গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন মেঘা। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে গভীর রাতে রুদ্র তাঁকে যাদবপুরের কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা গিয়েছেন ওই মহিলা। হাসপাতাল থেকে যাদবপুর থানা এবং সেখান থেকে বিষয়টি জানানো হয় গড়ফা থানায়।
আইন অনুযায়ী ময়না–তদন্তও হয় মেঘার দেহের। কিন্তু সেই ইস্তক সঙ্গিনীর দেহ পেতে পুলিশ–প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন রুদ্র। মেঘার দেহ পাওয়ার অধিকারী যে তিনিই, ভালোবাসার সেই অধিকারের কোনও কাগুজে প্রমাণ রুদ্র দিতে পারেননি। ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ দু’জন একসঙ্গে থেকেছেন, লিভ–ইন রিলেশনশিপে বেঁচেছেন নিজেদের মতো করে— আইনি বা আনুষ্ঠানিক দাম্পত্য গড়ে তোলার কথা ভাবেননি তাঁরা। একে অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা থেকে।
তাতে কী?
সেই ভালোবাসার পক্ষে কোনও কাগুজে প্রমাণ দেখাতে না–পেরে বার বার প্রত্যাখ্যাত রুদ্র শেষমেশ মেঘার দেহ পেতে দ্বারস্থ হন কলকাতা হাইকোর্টের। সোমবার হাইকোর্ট তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়েছে। এ দিন বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ জানিয়েছেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গড়ফা থানাকে ওই মহিলার মৃত্যুর নিয়ে তৈরি রিপোর্ট পৌঁছে দিতে হবে কাটাপুকুর মর্গে, আর ওই নথি পেলেই দেহ (মেঘার) তুলে দিতে হবে মামলাকারীকে (রুদ্র)।
আদালত সূত্রের খবর, একটি বেসরকারি সংস্থার উচ্চ পদে কর্মরত রুদ্রর তিন কুলে কেউ নেই। একই অবস্থা ছিল মেঘারও। একটি অনাথ আশ্রম থেকে মেঘাকে দত্তক নিয়েছিলেন এক দম্পতি। কিন্তু মেঘা যখন প্রাপ্তবয়স্ক, তখন এক পথ দুর্ঘটনায় ওই দম্পতি মারা যান। কোনও রকমে বেঁচে যান মেঘা। তবে ওই দম্পতির পরিবারের কেউ তাঁকে ঠাঁই দিতে রাজি হননি। মেঘার ভবিষ্যৎ যখন অনিশ্চিত, অন্ধ গলিতে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম, ঠিক তখনই রুদ্রর সঙ্গে তাঁর পরিচয়। তার কিছু দিনের মধ্যেই শুরু দু’জনের একত্রবাস।
রুদ্রর আইনজীবী ঋদ্ধিমান মুখোপাধ্যায় হাইকোর্টে জানান, লিভ টুগেদার করেন বললে পাছে বাড়ি ভাড়া না–পান, সেই আশঙ্কা থেকে ওই দু’জন গড়ফায় নিজেদের বিবাহিত দম্পতি হিসেবেই পরিচয় দিয়েছিলেন। বাড়িভাড়ার চুক্তি হয়েছিল পুরুষ পার্টনারের নামে। বাড়িওয়ালার নামে গড়ফার ওই বাড়ির ইলেকট্রিক মিটার। আবার ওই মহিলার কোনও স্থায়ী ঠিকানা ছিল না, তিনি কোনও দিন আধার কার্ডও করাননি। একই কারণে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট–ও হয়নি। এমনকী, তাঁদের কোনও জয়েন্ট অ্যাকাউন্টও ছিল না। তবে হাইকোর্টে এ দিন পুলিশের তরফে জানানো হয়, মহিলার মৃত্যুর পরেই গড়ফা থানার পুলিশ ওই ভাড়াবাড়িতে গিয়ে বাড়িওয়ালা ও আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, ওই দু’জন দীর্ঘদিন সেখানে একসঙ্গে থাকতেন।