• বক্সার জঙ্গলে বিপন্ন গ্রে লাঙ্গুর কি বাঘের মতোই পরিযায়ী
    এই সময় | ১৮ মার্চ ২০২৫
  • এই সময়, আলিপুরদুয়ার: খাতায়কলমে তার বাস হিমাচল প্রদেশে, চাম্বা উপত্যকায়। সে কি না এসে ডেরা বেঁধেছে বক্সার জঙ্গলে? উত্তরবঙ্গে বেড়াতে এসে বক্সা টাইগার রিজ়ার্ভে ছবি তুলতে গিয়ে ডানকুনির টুবাই মান্না ক্যামেরাবন্দি করেন একটি লাঙ্গুরকে। দূর থেকে স্পষ্ট, সেটি লাঙ্গুর।

    কিন্তু কোন প্রজাতির? ক্যামেরা জ়ুম করে দেখে টুবাইয়ের দাবি, প্রায় ২৮০০ ফুট উচ্চতায় বক্সার জঙ্গলে একটি গাছের মগডালে বসে থাকা প্রাণীটি হিমালয়ান গ্রে লাঙ্গুর, যা চাম্বা সেক্রেড লাঙ্গুর (Semnopithecus ajax) বলেও পরিচিত। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজ়ারভেশন অফ নেচারের (আইইউসিএন) রেড লিস্টে 'ক্রিটিক্যালি এনডেঞ্জার্ড' হিসেবে উল্লিখিত এই প্রাণীর সংখ্যা গোটা বিশ্বে মেরেকেটে দেড় হাজার। মূলত এদের বসবাস (ডিস্ট্রিবিউশন) হিমাচলের চাম্বা, পাক অধিকৃত কাশ্মীর, উত্তর পাকিস্তান, আফগান‍িস্তান এবং নেপাল–ভুটানে।

    স্বাভাবিক ভাবেই, উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে এমন বিরল প্রাণীর দেখা পাওয়ার খবরে রাজ্য বন দপ্তর খুশি। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, যতক্ষণ না বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লাঙ্গুরটির স্ক্যাট (মল) বা ডিএনএ বিশ্লেষণ হচ্ছে, তত ক্ষণ তার প্রজাতি নিয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।ঘটনা হলো, বন দপ্তরের নথি অনুযায়ী ২০১৮ সালে বক্সা টাইগার রিজ়ার্ভে প্রথমবার হিমালয়ান গ্রে লাঙ্গুরের দেখা মিলেছিল। তখন অবশ্য সেই ছবি সামনে আনেননি বনাধিকারিকরা। তবে এ বার পর্যটকের ক্যামেরাতেও লাঙ্গুরের ছবি ওঠায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বন দপ্তর।

    বক্সার ফিল্ড ডিরেক্টর অপূর্ব সেনের কথায়, ‘আমরা জানতাম যে বক্সায় হিমালয়ান গ্রে ল্যাঙ্গুরের বসতি (হ্যাবিট্যাট) রয়েছে। এতদিন তা প্রকাশ্যে আনা হয়নি। তবে ওই বিশেষ প্রজাতির লাঙ্গুরের সংখ্যা নিয়ে এখনও আমাদের কাছে কোনও নথি নেই। ভবিষ্যতে শুমারি করার কথা ভাবা যেতে পারে।’ হিমালয়ান গ্রে লাঙ্গুর সারা বছর গাছের পাতা, ফুলের কুঁড়ি ও নানা ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। চাম্বার চাষের জমিতেও এদের অবাধ যাতায়াত। টুবাইয়ের কথায়, ‘অনেকটা দূরে উঁচু গাছের মগডালে অদ্ভুত দেখতে বন্যপ্রাণী দেখে থমকেছিলাম। তার পরে ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে বুঝতে পারি, ওটা হিমালয়ান গ্রে লাঙ্গুর। বন্যপ্রাণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার ওই প্রজাতির লাঙ্গুর নিয়ে ধারণা ছিল।’

    তথ্য বলছে, হিমাচলের চাম্বা উপত্যকার জঙ্গলে একটি নির্দিষ্ট পরিসরে এই লাঙ্গুরের দেখা মেলে। ২০০৪ সালের আগে এদের স্বতন্ত্র পরিচয় ছিল না, এই লাঙ্গুরদের বেঙ্গল সেক্রেড লাঙ্গুরের (Semnopithecus entellus) মধ্যেই গণ্য করা হতো। গত ৮–১০ বছরে চাম্বায় যে ভাবে জনবসতি এগিয়েছে, একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জঙ্গল কাটা পড়েছে, তার জেরে লাঙ্গুরের বসতি কমেছে। যদিও তার মানেই চাম্বার লাঙ্গুর বক্সায় ঢুকে পড়েছে, এমন ভাবনা অতি সরলীকৃত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।

    জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার এক প্রবীণ বিজ্ঞানীর কথায়, ‘বক্সার জঙ্গলে যদি হিমালয়ান গ্রে লাঙ্গুর দেখা যায়, তবে নিশ্চিত ভাবেই সেটি মাইগ্রেটেড, অর্থাৎ অন্য এলাকা থেকে এসেছে। কারণ ওই জঙ্গলে তার বসতি বা হ্যাবিট্যাট থাকার প্রমাণ এখনও মেলেনি। তা ছাড়া হিমাচল না–হয়ে পড়শি নেপাল থেকেও আসতে পারে প্রাণীটি। কারণ চাম্বা অত্যন্ত শুকনো এলাকা, বক্সার আবহাওয়া অনেক বেশি আর্দ্র। তার সঙ্গে নেপালের আবহাওয়ার মিল বেশি। অনেক সময়ে বৃষ্টির তারতম্য বা জলবায়ুগত সামান্য পরিবর্তনেও এমন মাইগ্রেশন হয়। বক্সার গ্রে লাঙ্গুরটি হিমালয়ান না নেপালি, সেটা শুধুমাত্র ছবির মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায় না। পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পরেই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব।’

  • Link to this news (এই সময়)