• স্পিভাকের পুরস্কারে আনন্দে ভাসছেন পুরুলিয়ার শবররা
    এই সময় | ১৮ মার্চ ২০২৫
  • সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায়, পুরুলিয়া

    খবরটা জানার পর থেকে আনন্দ আর বাঁধ মানছে না প্রশান্ত রক্ষিত, নন্দলাল রাজোয়াড়, মেঘনাদ শবরদের। তাঁদের দিদিমণি যে মস্ত পুরস্কার পেয়েছেন। পুরুলিয়ার শবর জনজাতির জন্যে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাংলার কন্যা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের কর্মকাণ্ড আজ বার বার মনে পড়ছে ওঁদের।

    গায়ত্রীর হলবার্গ পুরস্কার পাওয়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া–শবর কল্যাণ সমিতির ডিরেক্টর প্রশান্ত রক্ষিতের মন্তব্য, ‘পুরস্কারটা ওঁর অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল। নোবেলের সমকক্ষ হলবার্গ পুরস্কার নয়, ওঁর নোবেলই পাওয়া উচিত। প্রান্তিক মানুষজন, বিশেষত শিশু ও মহিলাদের জন্যে তিনি যা করেছেন—তা হয়তো অনেকেই জানেন না, কিন্তু আমরা জানি। পুরুলিয়ার শবর জনজাতি জানে। তাঁদের শিক্ষার জন্যে অভিনব ব্যবস্থা নিয়েছিলেন গায়ত্রীদি।

    শুরুটা ১৯৮৮ সালে। তার পর থেকে বেশ কয়েক বছর শবরদের কল্যাণে গায়ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন প্রশান্তরা। সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনজাতি শবরদের উন্নয়নে শিক্ষায় সব থেকে বেশি জোর দিয়েছিলেন গায়ত্রী। নিজের খরচে গড়ে তুলেছিলেন চারটি নন ফর্মাল স্কুল। ১৯৮৯ সালে এই স্কুলগুলিতে চালু করেন মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা। বাস্তবে সেটাই ছিল পড়ুয়াদের জন্যে প্রথম মিড–ডে মিলের ব্যবস্থা। যা পরে সব স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু হয়েছে সরকারি উদ্যোগে।

    সে কথা স্মরণ করে প্রশান্ত বলেন, ‘১৯৯৪ পর্যন্ত এই স্কুলগুলির জন্যে সমানে অর্থ দিয়ে গিয়েছেন দিদি। গোপীবল্লভ সিং দেও শবরদের উন্নয়নে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া–শবর কল্যাণ সমিতি। পরে ১৯৮৩ সালে প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী সমিতিতে যোগ দেন। শবরদের জন্যে বহু বার পুরুলিয়ায় এসেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গেই পুরুলিয়ার রাজনোয়াগড়ে আসেন গায়ত্রীদি।’

    প্রশান্ত জানান, শবর শিশুদের শিক্ষার জন্যে নিজের অর্থে কয়েকটি নন ফর্মাল সেন্টার চালু করতে চেয়ে মহাশ্বেতা দেবীকে প্রস্তাব দেন গায়ত্রী। সেই মতো মানবাজার-১ ব্লকের কুদা ও জনাড়া, পুঞ্চা ব্লকের ব্যাঙ্গথুপি ও পুরুলিয়া-১ ব্লকের অকড়বাইদ গ্রামে নন ফর্মাল সেন্টার শুরু হয়। ফি–বছর ডিসেম্বরে রাজনোওয়াগড়ে আসতেন গায়ত্রী। স্কুলে গিয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলতেন। শিক্ষকদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করতেন শবর শিশুদের শিক্ষার বিষয়ে। প্রশান্ত বলেন, ‘এই সময়েই শিশুদের পুষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয় তাঁর। যদি মিড–ডে মিল চালু করা হয় তা হলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উপস্থিতি বাড়বে। তারা পড়ার আনন্দও পাবে বলে নিশ্চিত ছিলেন তিনি।’

    সে দিনের কথা স্মরণে রয়েছে ব্যাঙ্গথুপির শিক্ষক নন্দলাল রাজোয়াড়েরও। তাঁর কথায়, ‘ওঁকে দেবী বলেই মনে করি আমরা। সমাজের নিম্ন স্তরে থাকা মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের জন্যে ওঁর যে চেষ্টা তার তুলনা হয় না। সেই সময়ে প্রতি বছর এসে আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন কী ভাবে বাচ্চাদের পড়াতে হবে। তাঁর পদ্ধতি অনুসরণ করায় শবর শিশুদের মধ্যে শিক্ষায় আগ্রহ বেড়েছিল। মিড–ডে মিলের কনসেপ্টও তাঁর। এতে শিক্ষায় মারাত্মক ভাবে পিছিয়ে থাকা শবর শিশুদের বিদ্যালয়ে আসা লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছিল। যা এখনও চলছে। শবরদের মধ্যে নিরক্ষরতার দূরীকরণ শুরু তখন থেকেই।’

    সে সময়ে প্রাথমিকে পড়া ব্যাঙ্গথুপি গ্রামের মেঘনাদ শবর খুব প্রিয় ছাত্র ছিলেন গায়ত্রীর। এখন প্রতিষ্ঠিত মেঘনাদ তাঁর দিদিমণির এতবড় পুরস্কার পাওয়ার খবরে উচ্ছ্বসিত। গায়ত্রী নোবেলও পাবেন বলে নিশ্চিত মেঘনাদ। তাঁর কথায়, ‘ওঁর স্কুলে পড়েছি। খুব ভালো লাগছে। আমাদের শবরদের জন্যে উনি যা করেছেন তা ভাষায় বলা যায় না। ওঁর দেওয়া মিড–ডে মিল খেয়েছি। ওই খাবারটা আমাদের অঞ্চলে তখন খুব জরুরি ছিল। আমাদের মধ্যে অনেকে উচ্চশিক্ষা পেয়ে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছি ওঁরই জন্যে।’

  • Link to this news (এই সময়)