• পাঁশকুড়া-চপ, নাম তো শুনাহি হোগা
    এই সময় | ১৮ মার্চ ২০২৫
  • দিগন্ত মান্না ■ পাঁশকুড়া

    মেলার সঙ্গে চপের কি কোনও বিশেষ সম্পর্ক আছে? তেলেভাজাপ্রেমীরা সমস্বরে বলবেন, 'আলবাত আছে। চপ বিনে মেলা জমে নাকি!' আর সেই চপ পাঁশকুড়ার হয় তা হলে কথাই নেই! রাজ্যের যে কোনও মেলায় পাঁশকুড়া চপের স্টল থাকেই। একই ব্যক্তি যে সব জায়গায় স্টল দেন, তেমনটা কিন্তু নয়। তবে ফ্লেক্সে 'পাঁশকুড়ার চপ' লেখা দেখলেই ক্রেতাদের ভিড় বাড়ে।ল্যাংচা বললেই মনে পড়ে শক্তিগড়ের কথা।

    মিহিদানা মানে বর্ধমান। ঠিক তেমনই, চপ মানেই জনপ্রিয়তার শিখরে পাঁশকুড়ার চপ। এই চপ প্রথম কে, কবে তৈরি করেছিলেন সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনও উত্তর না-পাওয়া গেলেও পাঁশকুড়ার চপকে 'ব্র্যান্ড' করার নেপথ্যে যাঁর ভূমিকা রয়েছে তিনি বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী। জিআই তকমা না-থাকলেও পাঁশকুড়ার ইতিহাস বলছে, চক্রবর্তীদের হাত ধরেই 'পাঁশকুড়ার চপ'-এর এমন রমরমা।সালটা ১৯৫০। দক্ষিণ পূর্ব রেলের হাওড়া খড়্গপুর শাখার পাঁশকুড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে টি-স্টল চালু করে রেল।

    'বিপি চক্রবর্তী অ্যান্ড সন্স' নামে প্রথম চালু হওয়া সেই স্টলের মালিক ছিলেন পাঁশকুড়ার বাহারগ্রামের বাসিন্দা বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী। স্টলেই পাওয়া যেত চা, শিঙাড়া, মিষ্টি। কিছুদিন পরে আলুর চপ তৈরি করতে শুরু করেন বিষ্ণুপদ। তাঁর নিজস্ব ফর্মুলায় দক্ষ কারিগরের সাহায্যে খাঁটি বাদাম তেলে শুরু হলো চপ ভাজা। অল্প দিনের মধ্যেই রেলযাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠল বিষ্ণুপদর চপ।

    স্থানীয়দের দাবি, এই চপ একাধিক খেলেও যেমন শরীর খারাপ হতো না, তেমনই ঠান্ডা হয়ে গেলেও নষ্ট হতো না চপের মুচমুচে ভাব। পাঁশকুড়া স্টেশনে ট্রেন থামলেই যাত্রীদের মধ্যে চপ কেনার হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। স্বাদ ও গুণমানের কারণে রেলযাত্রীদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সেই বিখ্যাত নাম— 'পাঁশকুড়ার চপ'।চপ বিক্রি করেই সাত ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিষ্ণুপদ। এখনও একান্নবর্তী পাঁশকুড়ার চক্রবর্তী পরিবার। তাঁদের মধ্যে কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষক আবার কেউ আইনজীবী।

    তবে বিষ্ণুপদর এক ছেলে আশুতোষ চক্রবর্তী ১৯৭৫ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে হাল ধরেন বাবার ব্যবসার। ২০১০ সালে মারা যান বিষ্ণুপদ। বাবার ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যান আশুতোষ। কয়েক বছর আগেও পাঁশকুড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে 'বিপি চক্রবর্তী অ্যান্ড সন্স'-এর পাঁচটি স্টল ছিল। তার জন্য রেলকে মাসে প্রায় ৬৬ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হত। প্রত্যেকটি স্টলেই পাওয়া যেত পাঁশকুড়ার চপ।চক্রবর্তী পরিবারের অভিযোগ, গত বছর জুনে রেল 'বিপি চক্রবর্তী অ্যান্ড সন্স'কে অনৈতিক ভাবে উচ্ছেদ করে। সেই থেকে রেলযাত্রীরাও বঞ্চিত হলেন পাঁশকুড়ার চপ থেকে।

    রেলের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মামলাও করেছেন 'পাঁশকুড়ার চপে'র বর্তমান মালিক আশুতোষ চক্রবর্তী। সেই মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। আশুতোষ এখন অসুস্থ।পাঁশকুড়া স্টেশনের অদূরে 'চক্রবর্তী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে' পাঁশকুড়ার চপ পাওয়া যায়। ঠাঁই হারানোর ফলে চপের বিক্রি কমছে। আশুতোষ অসুস্থ বলে এখন চপের ব্যবসার দেখভাল করেন তাঁর এক ভাই অমিতাভ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, 'আমার বাবার তৈরি চপই পাঁশকুড়ার চপ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফুড লাইসেন্স, পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট, কর্মচারী স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট আপডেট করে আমরা আজও ব্যবসা চালাচ্ছি। রেল আমাদের অনৈতিক ভাবে সরিয়ে দেওয়ায় চপের বিক্রি কমেছে। আগে পঞ্চাশ জন কর্মচারী কাজ করতেন। এখন মাত্র তিন-চার জন আছেন।'

    অমিতাভের সংযোজন, 'বাবার হাত ধরে পাঁশকুড়ার চপ এতটাই জনপ্রিয় হয় যে এখন অনেকেই পাঁশকুড়ার চপের নামে তাদের চপ বিক্রি করছে। এতে আমরা এতটুকুও বিচলিত নই। যে স্বাদের জন্য পাঁশকুড়ার চপ বিখ্যাত, সেই স্বাদ এখনও অটুট রেখেছি।'ট্রেনে টানা ৪১ বছর ধরে চপ বিক্রি করেন সুশান্ত চক্রবর্তী। তিনি বলছেন, 'বিষ্ণুপদর কাছে আমি তিন বছর কাজ করেছি। ওঁর তৈরি চপ নিয়ে আগে ট্রেনে বিক্রি করতাম। ট্রেনের কামরায় পাঁশকুড়ার চপ বললেই মুহূর্তের মধ্যে সব বিক্রি হয়ে যায়। এক একটি চপের দাম ১০ টাকা।

    'পাঁশকুড়ায় 'কাকার চপ' নামে একটি দোকানের মালিক সৌমেন দাস বলেন, 'আমার দাদু ৩৯ বছর আগে চপের ব্যবসা শুরু করেন। এখন সেই ব্যবসা আমি চালাই। পাঁশকুড়ার চপ নামেই আমরা চপ বিক্রি করি। আলুর সঙ্গে হরেক কিসিমের মশলা মিশিয়ে চপের স্বাদ বাড়ানো হয়। প্রতিদিন গড়ে ২০০ পিস চপ বিক্রি হয়।' পাঁশকুড়া বাসিন্দা, পেশায় শিক্ষক আলোক মাইতির কথায়, 'বিভিন্ন মেলায় পাঁশকুড়ার চপ নামে নানা রকম চপ বিক্রি হয়। কিন্তু আসল পাঁশকুড়ার চপ পাওয়া যায় পাঁশকুড়াতেই। বাকি সব নকল।' আলুর চপের পাশাপাশি পাঁশকুড়ায় মোচার চপ, ভেজিটেবল চপও এখন তৈরি হয়। তবে এখনও স্বাদে, গুণমানে হিট সেই 'পাঁশকুড়া চপ'।

  • Link to this news (এই সময়)