মাদক ও সমকামিতার আবহে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার ঘিরে বিতর্ক! কী বলছেন বাংলার শিল্পীরা?
আনন্দবাজার | ১৮ মার্চ ২০২৫
রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবহে মাদকের উদ্যাপন। সম্প্রতি এমনই এক দৃশ্যের সাক্ষী থাকলেন ওটিটি দর্শক। কিছু দিন আগেই মুক্তি পেয়েছে হিতেশ ভাটিয়া পরিচালিত ওয়েব সিরিজ় ‘ডব্বা কার্টেল’। এই সিরিজ়ের একটি দৃশ্য নিয়ে বাঙালি ওটিটি দর্শকের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। তিন সমকামী মহিলা মাদকাসক্ত হয়ে উদ্দাম নৃত্য করছেন। পরস্পরের প্রতি ভালবাসাও ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এই দৃশ্যে অবশ্য আপত্তি তোলার মতো কোনও বিষয় নেই। কিন্তু বিতর্কের সূত্রপাত এই দৃশ্যের আবহসঙ্গীত নিয়ে। ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানের কেবল একটি পংক্তি রয়েছে সেখানে। সেটি হল— ‘তাতা থৈ থৈ’। গানটি শুনলে বোঝা যায়, স্বরলিপিরও বদল হয়েছে।
তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, সিরিজ়ের এই দৃশ্যে কতটা প্রয়োজন ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত? কপিরাইট নেই বলেই কি যত্রতত্র ব্যবহার করা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান? এমনই কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখল আনন্দবাজার ডট কম। সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র মনে করিয়ে দিয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি ‘চিত্রাঙ্গদা’র কথা। সেই ছবির গান ‘বঁধু কোন আলো লাগল চোখে’ গানের সঙ্গে দুই সমকামী পুরুষের প্রেম তুলে ধরা হয়েছিল। গানটি গেয়েছিলেন কৌশিকী চক্রবর্তী। উল্লিখিত সিরিজ়টি যদিও দেখেননি দেবজ্যোতি। তিনি বলেছেন, “একটি গান যা বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম একজন প্রধান কবি ও সুরকার এই গান বেঁধেছেন। এমন একটি গান দার্শনিক ভাবে একটি জায়গায় আবদ্ধ থাকবে না। আমি ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবিতে সমকামী অনুষঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করেছি। ঋতুপর্ণ অত্যন্ত বোধশক্তি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। আমিও সবটা বুঝেই এই গানের প্রয়োগ করেছি। তাই মনে হয়নি, কোনও অপরাধ করেছি।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানকে সাধারণত স্বর্গীয় অনুষঙ্গে দেখা হয় বলে মনে করেন তিনি। সেই দৃষ্টভঙ্গি থেকে সমকামকেই অন্য চোখে দেখা হয়। কিন্তু সমস্ত দিক বিবেচনা করেই ‘চিত্রাঙ্গদা’তে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ করা হয়েছিল। ‘ডব্বা কার্টেল’ প্রসঙ্গে দেবজ্যোতি বলেন, “আমি এই সিরিজ়টি দেখিনি। তাই বলা ঠিক হবে না। রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করাকে আমি অপরাধ বলে মনে করি না। তাঁর গান ব্যবহার করলেই কি সাংঘাতিক তুলকালাম হয়ে যাবে! তেমন হলে রবীন্দ্রনাথকে খুব ছোট জায়গায় আবদ্ধ করা হবে।” একই সঙ্গে তিনি বলেন, “কিন্তু এই দৃশ্যে কি সেই গান যুক্তিযোগ্য বা দৃশ্যটিকে কি উতরে দিকে পেরেছে? রবীন্দ্রনাথ ‘ক্লাসিক’। তাই সুযোগ পেয়ে তাঁকে ভেঙেচুরে তৈরি করা হচ্ছে, সেটা আমি সমর্থন করব না।”
দেবজ্যোতির স্পষ্ট বক্তব্য, "দৃশ্যে গানটি কেমন ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটাই সবার আগে দেখা প্রয়োজন। এই গান ব্যবহারে কি দৃশ্যের উত্তরণ হচ্ছে? অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করলে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। একটি হিন্দি সিরিজ়ে ‘মম চিত্তে’ গানের ব্যবহার করা হচ্ছে কেন, সেটাও বুঝতে হবে। এই গানে অসাধারণ ছন্দ ও সুর আছে। কিন্তু গানের ব্যবহারের পিছনে উদ্দেশ্যটা দেখা প্রয়োজন।”
এই সিরিজ়টি দেখেছেন গায়ক রূপঙ্কর বাগচী। ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ এই গানের সঙ্গে মাদকের কোনও সম্পর্ক নেই বলেই মত গায়কের। তাই ঠিক কোন উদ্দেশ্যে এই গানের ব্যবহার তাও তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। তবে দৃশ্যায়নের থেকেও গানের সুরের বদল ভাবিয়েছে তাঁকে। রূপঙ্কর বলেছেন, “গানটির সুরের একটু পরিবর্তন করা হয়েছে। এটা মোটেই ঠিক হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত তৈরি করেছেন। তাঁর সুর বদলে দেওয়া অন্যায়। কোন দৃশ্যে গানটি ব্যবহার হয়েছে তার থেকেও আমার কাছে বড় বিষয়, এই গানের সুর বদল করা হয়েছে।”
গানের দৃশ্যের বিশ্লেষণে যেতে চান না রূপঙ্কর। বহু গানেরই ভিন্ন ব্যবহারিক প্রয়োগ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তাই তিনি বলেছেন, “দৃশ্যটিতে সকলে মাদকাসক্ত হয়ে নাচছিলেন। ‘মম চিত্তে’ গানের সঙ্গে মানুষ নাচতেই পারে। কিন্তু সুরের পরিবর্তন করাটা অন্যায় হয়েছে।”
সুরের বদল নিয়ে আপত্তি রয়েছে শ্রাবণী সেনেরও। ওয়েব সিরিজ় এখনও দেখেননি। তাই তিনি বলেন, “বিষয়টি শুনেই বলছি, সমর্থন করছি না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কেন হচ্ছে এমন, বুঝে উঠতে পারি না!” স্বত্বাধিকার উঠে যাওয়ার ফলেই যেখানে সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করেন শ্রাবণী। তিনি বলেছেন, “খুব কড়া আইন না হলেও, বিশ্বভারতীর দ্বারা নূন্যতম কিছু বিধিনিষেধ তৈরি হওয়া দরকার। অন্তত এগুলো যেন দেখা হয়, কোথায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা যাবে, কোথায় যাবে না। গানের কথা ও সুরের পরিবর্তন হচ্ছে কি না, সেটাও দেখা দরকার। রবীন্দ্রনাথ যেটুকু করার করে দিয়ে গিয়েছেন। আমরা শুধু সঙ্গীতায়োজনে বদল আনতে পারি মাত্র।”