• ‘মারি তো গন্ডার’ অতীত, উত্তরবঙ্গের একশৃঙ্গদের জন্য এ বার জেনেটিক স্টাডিও
    এই সময় | ১৯ মার্চ ২০২৫
  • একশৃঙ্গ গন্ডার সংরক্ষণে ফের সাফল্যের পালক উত্তরবঙ্গের মুকুটে। মাত্র ১২ বছরে গন্ডারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করে ফেলল জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। দেশের মধ্যে অসমের কাজিরাঙার পরেই সবথেকে বেশি একশৃঙ্গ গন্ডার (Rhinoceros unicornis) এখন জলদাপাড়ায়। সংখ্যায় এতটা না-হলেও বিপন্ন এই প্রজাতির প্রতিনিধি বেড়েছে গোরুমারাতেও।

    উত্তরবঙ্গের জলদাপাড়া, গোরুমারা, চাপড়ামারি এবং জলপাইগুড়ির জঙ্গলে মার্চের ৩ থেকে ৬ তারিখ শুমারি করে বন দপ্তর জানাচ্ছে, সেখানে এখন প্রায় ৩৯২টি একশৃঙ্গ গন্ডার রয়েছে। গত কয়েক বছরে চোরাশিকার রোখা এবং বন্যপ্রাণ আইনের প্রয়োগে অপরাধীদের কড়া শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে জলদাপাড়া। সাম্প্রতিক শুমারিতে সেই নিরবচ্ছিন্ন নজরদারির সুফল স্পষ্ট, মনে করছেন বনকর্তারা। একই সঙ্গে, এই প্রথম উত্তরবঙ্গের গন্ডারদের জিনগত বিশ্লেষণের পথেও হাঁটতে চলেছে রাজ্য।

    ১৯৮৪–তে যখন প্রথম জলদাপাড়ায় গন্ডার গোনা হয়, তখন তাদের সংখ্যা ছিল মেরেকেটে ১৪। তার পরের চার দশকে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে যেমন গন্ডারের বসতি ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে, তেমনই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চোরাশিকার। তার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থানও বনাধিকারিকদের চিন্তার কারণ। কাছেই একাধিক আন্তর্জাতিক সীমান্ত, রাজ্য সীমানা। তার ফলে বন্যপ্রাণের শিকার ও চোরাচালানের অন্যতম ট্রানজ়িট পয়েন্ট হয়ে উঠেছিল শিলিগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের একাধিক এলাকা। সেই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে একশৃঙ্গ গন্ডার বাঁচানোর লক্ষ্যে গত এক যুগে বেশ কিছু কড়া পদক্ষেপ করেছিলেন বনাধিকারিকরা। তার মধ্যে অন্যতম, বন্যপ্রাণ হত্যা-চোরাচালানে জড়িত অপরাধীদের ধরে তাদের সাজা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি কাজে এসেছে ‘হ্যাবিট্যাট ম্যানেজমেন্ট’ এবং পুলিশের কড়া নজরদারি।

    জলদাপাড়ার ডিএফও পরভিন কাসওয়ানের কথায়, ‘গত চার বছরে জলদাপাড়ায় একটাও চোরাশিকার হতে দিইনি আমরা। যদিও শুধু চোরাশিকার রুখে গন্ডারের সংখ্যা এতটা বাড়ানো যায় না। এই সাফল্যের কারণ জলদাপাড়ার গন্ডাররা (বেস পপুলেশন) জন্মগত ভাবে যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান। তার সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে উন্নত হ্যাবিট্যাট ম্যানেজমেন্ট, পর্যাপ্ত জলাশয় রাখা, জঙ্গলে রাত-দিন নজরদারি সার্বিক ভাবে গত ১২ বছরে একশৃঙ্গ গন্ডারের সংখ্যা ১৮৬ থেকে ৩৩১-এ নিয়ে গিয়েছে।’

    গন্ডারের ‘হেলদি পপুলেশন’ যখন চারশো ছুঁইছুঁই, তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এদের মধ্যে জিনগত তারতম্য কতটা? কারণ সব গন্ডার একই জিন পুলের সদস্য হলে যে কোনও মারণ রোগে প্রচুর প্রাণীর একসঙ্গে মৃত্যুর বা মড়ক পরিস্থিতি তৈরির সম্ভাবনা প্রবল। সেই কথা মাথায় রেখে তাই রাজ্য বন দপ্তর এ বার জলদাপাড়া ও গোরুমারার গন্ডারদের জিনগত বৈশিষ্ট বিশ্লেষণের কাজে নামছে।

    পশ্চিমবঙ্গের হেড অফ ফরেস্ট দেবল রায়ের কথায়, ‘গন্ডার বাঁচানোর ক্ষেত্রে দুটো ফ্যাক্টর জরুরি ছিল। প্রথমত চোরাশিকার রোখা, দ্বিতীয়ত কোনও রোগের সংক্রমণ বা মড়ক পরিস্থিতি হতে না-দেওয়া। দুটোই সাফল্যের সঙ্গে করা গিয়েছে। এ বার দেরাদুনের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার (ডব্লিউআইআই) সহযোগিতায় আমরা উত্তরবঙ্গের দুটো জঙ্গলে গন্ডারদের ‘জেনেটিক স্টাডি’ শুরু করছি। সরকারের তরফে সম্মতি দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীরা গন্ডারের ডাং (মল) কালেক্ট করে সেখান থেকে ডিএনএ নমুনা নিয়ে তা বিশ্লেষণ করবেন। আমাদের রাজ্যে একশৃঙ্গ গন্ডারদের মধ্যে জিনগত বৈচিত্র্য বাড়ানোর প্রয়োজন কতটা, সেটা ওই বিশ্লেষণ থেকেই স্পষ্ট হবে।’

    গত ৩ মার্চ উত্তরবঙ্গের ৩৯৬ বর্গ কিমি জঙ্গল এলাকায় শুরু হয়েছিল গন্ডার সুমারির কাজ। ৬৩১ জন বনকর্মী, ৮৫টি কুনকি হাতি এবং পশ্চিমবঙ্গ-অসমের ১৫টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার যৌথ ব্যবস্থাপনায় টানা চার দিন চলেছে শুমারি। জলদাপাড়ার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, জঙ্গলের পূর্ব ভাগে রয়েছে ১৪৩টি গন্ডার। উত্তরে ৬৩, পশ্চিমে ৫৫, চিলাপাতায় ৪০ এবং কোদালবস্তিতে ৩৩টি গন্ডারের বাস। গোরুমারার ৬১টি গন্ডারের ২৬ থেকে ২৮% এখন শাবক। জলদাপাড়ার গন্ডারদের ২০%-ও তাই। ফলে আগাম ভবিষ্যতে দুই জঙ্গলেই একশৃঙ্গ গন্ডারের ‘হেলদি পপুলেশন’ থাকবে, আশা করছেন বনাধিকারিকরা।

  • Link to this news (এই সময়)