‘কত সন্তান জ্বালাল প্রেয়সী তোমার আমার চিতা…’ চৈত্রের এলোমেলো বাতাসে উড়ে যায় আগুনের কুচি। নীরবে, অলক্ষ্যে, অজান্তে। সন্তান নয়, সরকারি ডোমের দেওয়া আগুনে ‘বেওয়ারিশ লাশ’ জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়ে যায় একসময়ে। একপাশে পড়ে থাকে কোর্টের লড়াই, দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর ক্লান্ত-অবসন্ন একটা জ্যান্ত শরীর।
টানা ৪২ দিন আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন রুদ্র (নাম পরিবর্তিত)। লাশকাটা ঘরের ঠান্ডা বাক্সে শুয়ে তাঁর মেঘা (নাম পরিবর্তিত)। চিরসঙ্গিনীকে অন্তিম বিদায় জানানোর আর্জি নিয়ে আদালতের দরজায় মাথা কুটেছিলেন রুদ্র। হাইকোর্ট সাড়াও দিয়েছিল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মেঘার দেহ রুদ্রর হাতে তুলে দিতে রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত (সে খবর ১৮-০৩-২০২৫, মঙ্গলবার ‘এই সময়’-এ প্রকাশিত হয়েছিল)।
কিন্তু তার পরে? জিতেও হেরে গেলেন রুদ্র। কাটাপুকুর মর্গে মেঘার দেহ নিতে গিয়ে জানলেন, সেটাও আর নেই। মর্গের ‘বেওয়ারিশ লাশ’-এর তালিকায় উঠেছিল মেঘার নাম। তাই পুরসভার ডোমেরা আর পাঁচটা দাবিদারহীন দেহের সঙ্গেই পুড়িয়ে দিয়েছেন মেঘার দেহ। জন্মের পর থেকে ‘অনাথ’ পরিচয়ে বেড়ে ওঠা মেঘা চলেও গেলেন একাকী, পরিচয়হীনা হয়েই।
অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না! কারণ বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ যখন দেহ সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখন রাজ্যের কৌঁসুলি জানিয়েছিলেন, মেঘার দেহ সংরক্ষিত রয়েছে কাটাপুুকুর মর্গে। তা হলে কী করে হলো? কিছু বুঝতে পারছেন না রুদ্র, সম্পূর্ণ অন্ধকারে তাঁর আইনজীবীরাও।
হাইকোর্টের নির্দেশের কপি হাতে নিয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে একবার গড়ফা থানা, একবার যাদবপুর থানা করে শেষ পর্যন্ত যখন রুদ্র মর্গে পৌঁছলেন, তখন সব শেষ — তাঁকে জানানো হয়, দেহ পুরসভা দাহ করে দিয়েছে। ‘বেওয়ারিশ লাশ’ হিসেবে। কবে? ডোম থেকে মর্গ-ইনচার্জ, সকলের কাছে জানতে চেয়েছেন রুদ্র। কেউ সেই তথ্য তাঁকে দেননি। গড়ফা থানা এলাকার ঝিল রোডে গত ১২ বছর ধরে লিভ-ইন করতেন রুদ্র ও মেঘা। গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেঘা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তড়িঘড়ি যাদবপুরের কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করেন রুদ্র। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই চিকিৎসকেরা জনান মেঘা আর নেই। হাসপাতালে আনার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। অতএব হাসপাতাল থেকেই খবর দেওয়া হয় যাদবপুর থানায়। তারা যাবতীয় নথি পাঠিয়ে দেয় গড়ফা থানায়। পর দিন গড়ফা থানার পুলিশ ঝিল রোডের ওই বাড়ি ও আশপাশের এলাকায় গিয়ে তদন্ত করে। দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাটাপুকুর মর্গে, ময়নাতদন্তের জন্য।
রুদ্রর আইনজীবী ঋদ্ধিমান মুখোপাধ্যায় ও রোশন ঝা-র বক্তব্য, পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট পেতে মামলা করার বহু আগেই থানাকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কাটাপুকুর মর্গেও লিখিত ভাবে গোটা ঘটনা জানিয়ে দেহ সংরক্ষিত করে রাখার আবেদন করা হয়। আইনজীবীদের আরও দাবি, ১২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে থানা এবং মর্গ মিলিয়ে হাফ ডজন চিঠি দেওয়া হয়। পুলিশের থেকে উত্তর না-পেয়ে মামলা করা হয় হাইকোর্টে। ৪ ফেব্রুয়ারি মামলাটি শুনানির জন্য ওঠার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ওঠে ১৪ ফেব্রুয়ারি। মনের মানুষটির নিষ্প্রাণ দেহ পাওয়ার জন্য প্রেমিকের আকুতি ওই ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তেই প্রথম শোনে কোর্ট। দু’জনের সম্পর্কের প্রমাণ এবং মেঘার নথি তলব করে আদালত।
কোনও এক অনাথ আশ্রম থেকে মেঘাকে দত্তক নিয়েছিলেন এক দম্পতি। কিন্তু ওইটুকু শিশুর জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে খুব অল্প সময়েই — পথদুর্ঘটনায় মারা যান মেঘার সেই মা ও বাবা। তার পরে জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে বেড়ে ওঠা আর পরিচয় রুদ্রর সঙ্গে। বাঁধা পড়েন দু’জন। একসঙ্গে থাকতে থাকতে কেটে যায় গোটা একটা যুগ।
রুদ্রর আইনজীবীরা সোমবার কোর্টে জানান, মেঘা মারা যাওয়ার পরে পুলিশ নিজে তদন্ত করে রিপোর্ট তৈরি করেছে। আদালত সেই রিপোর্ট দেখে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেহ রুদ্রর হাতে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মেঘার দেহ এ ভাবে পুড়িয়ে দেওয়ার দায় কার? রুদ্রর অন্য দুই আইনজীবী ঘনশ্যাম ঝা এবং সৌজন্য পট্টনায়েকের দাবি, পুলিশের তৈরি করা রিপোর্ট বারবার চাওয়া হয়েছিল গড়ফা থানার কাছে। কিন্তু পুলিশ সেই রিপোর্ট দেয়নি। অথচ হাইকোর্ট পুলিশের সেই রিপোর্টকে মান্যতা দিয়ে তার ভিত্তিতেই দেহ রুদ্রর হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সেটা আগে দিলেই আর মেঘার লাশ পেতে রুদ্রকে কোর্টে যেতে হতো না। কিন্তু কেন পুলিশ রিপোর্ট দিল না? পুলিশের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েই আমরা খতিয়ে দেখছি। যাঁর গাফিলতি পাওয়া যাবে, তাঁর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেব।’
আর রুদ্র? মঙ্গলবার রাতে ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসে — ‘কথা বলার অবস্থায় নেই আমি। তবে একটু সময় দিন। এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব। আদালতেই…’
মেঘার চিতার আগুন তাঁর বুকে রাখা রয়েছে সযত্নে…