এই সময়, নয়াদিল্লি: রাজ্য অনগ্রসর শ্রেণি কমিশনের তরফে জারি করা প্রায় ১২ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র গত বছরের মে মাসে বাতিল করে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট৷ সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে পাল্টা মামলা দায়ের করেছিল পশ্চিমবঙ্গ অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন (ডব্লিউবিসিবিসি)৷
মঙ্গলবার এই মামলার শুনানিতেই শীর্ষ আদালতের বিচারপতি বিআর গভাই এবং বিচারপতি অগস্টিন জর্জ মসিহর বেঞ্চে রাজ্য সরকারের তরফে সওয়াল করতে গিয়ে বর্ষীয়ান আইনজীবী কপিল সিবাল বলেন, ‘নতুন করে সমীক্ষার মাধ্যমে ওবিসি তালিকা খতিয়ে দেখবে রাজ্য সরকার৷ পশ্চিমবঙ্গ অনগ্রসর শ্রেণি কমিশনের তরফে করা হবে এই সমীক্ষার কাজ৷ আগামী তিন মাসের মধ্যে শেষ করা হবে এই কাজ৷’ এই মর্মেই সিবালের আর্জি, তিন মাস পরে এই মামলার শুনানি করা হোক৷ তাঁর এই আর্জিতে মান্যতা দিয়ে বিচারপতি গভাই ও বিচারপতি মসিহর বেঞ্চ জানিয়েছে, জুলাই মাসে হবে এই মামলার পরবর্তী শুনানি৷ বিচারপতি বিআর গভাইয়ের পর্যবেক্ষণ, পুরো প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখে নতুন করে ওবিসি শংসাপত্র ইস্যু করার কথা বলা হলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়৷
প্রবীণ আইনজ্ঞদের অনেকেই অবশ্য বলছেন, সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের এই অবস্থান মামলার আগের শুনানিগুলির তুলনায় অনেকটাই আলাদা। শুধু তা–ই নয়, নতুন করে সমীক্ষার কথা বলে আসলে কলকাতা হাইকোর্টের দেওয়া রায়ই কার্যত মেনে নিল রাজ্য সরকার। ফলে বিরোধীরা রাজনৈতিক ভাবে সরকারকে বেঁধারও সুযোগ পাবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
রাজ্য সরকার যে ওবিসি তালিকা নিয়ে নতুন করে সমীক্ষা করতে চলেছে, সে খবর প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘এই সময়’–এ। গত বছর ২২ মে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, রাজ্য সরকার যে ৭৭টি শ্রেণিকে ওবিসি তালিকাভুক্ত করেছে তা বৈধ নয়। ফলে প্রায় ১২ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র খারিজ হয়ে যায়। যার প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন রাজ্য সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও। রাজ্য সুপ্রিম কোর্টে গেলে সেখানে আদালত জানায়, কী ভাবে এই ৭৭টি শ্রেণিকে ওবিসি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দিতে হবে।
তারপরে রাজ্য একাধিকবার শীর্ষ আদালতে যুক্তি দিয়ে জানিয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতে এই সংযোজন হয়নি। সামাজিক ও আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকেই নিয়ম মেনে ওবিসি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বর্ষীয়ান আইনজ্ঞদের বড় অংশ মনে করছেন, এতদিন এই যুক্তিতে সওয়াল করার পরে মঙ্গলবার আচমকাই রাজ্য জানাল, তারা এই বিষয়টি তিন মাসের মধ্যে নতুন করে সমীক্ষা করবে। তাঁদের যুক্তি, বিরোধীরা অনেকেই হাইকোর্টের রায়ের পরে অভিযোগ তুলেছে যে, নিছক ভোটের কথা ভেবে ধর্মের ভিত্তিতে এই ওবিসি তালিকা তৈরি হয়েছিল। এখন রাজ্য ও কমিশন কার্যত মেনেই নিল যে, ওবিসি তালিকায় ওই ৭৭টি শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করার সময়ে নির্দিষ্ট পদ্ধতি মানা হয়নি এবং হাইকোর্টের নির্দেশই সঠিক ছিল। তা হলে রাজ্য সুপ্রিম কোর্টে তা চ্যালেঞ্জ করল কেন?
এই আইনজ্ঞদের যুক্তি, এর ফলে শুধুমাত্র ওই ৭৭টি শ্রেণিকে ওবিসি তালিকাভুক্ত করা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে তা–ই নয়, অন্য শ্রেণির ক্ষেত্রেও একই সংশয় দানা বাঁধতে বাধ্য। এতদিন হাইকোর্টের রায়ের উপর সুপ্রিম কোর্ট কোনও স্থগিতাদেশ জারি করেনি। ফলে ওবিসি শংসাপত্র নিয়ে জটিলতা চলছিলই। এখন আবার নতুন করে সমীক্ষার ফলে যে সময় লাগবে, তাতে এই ৭৭টি শ্রেণির তালিকাভুক্তদের আবারও ভুগতে হবে। তা ছাড়া নতুন সমীক্ষায় যদি এই ৭৭টি শ্রেণির তালিকাভুক্তি নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়, তা হলে সার্বিক ভাবে গোটা ওবিসি শংসাপত্র নিয়েই বড়সড় বিভ্রান্তি দেখা দেবে এবং তার প্রভাব পড়বে সর্বত্র।
রাজ্য সরকারের প্রায় প্রতিটি বিভাগ বা দপ্তরে নিয়োগেও প্রবল সমস্যা হবে। নতুন করে আইনি জটিলতাও তৈরি হতে বাধ্য। এক কথায় অচলাবস্থা তৈরি হবে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে। নতুন সমীক্ষায় যে শ্রেণির মানুষ ঠাঁই পাবেন না, তাঁদের ক্ষোভ সামাল দিতেও বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হবে সরকারকে। আইনজ্ঞদের আর একটি অংশের ব্যাখ্যা, কলকাতা হাইকোর্টেও রাজ্য একাধিকবার জানিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টে ওবিসি মামলার ফয়সালা না–হওয়া পর্যন্ত তারা কোনও নিয়োগ করবে না। তারপরেও পুরোনো পদ্ধতি মেনে একাধিক দপ্তরে নিয়োগ করতে গিয়ে আদালতের প্রশ্নের মুখে পড়েছে রাজ্য সরকার। এমনকী, রাজ্যের মুখ্যসচিবকে হাইকোর্টের উষ্মার মুখেও পড়তে হয়েছে। এ দিন শীর্ষ কোর্টে রাজ্যের সওয়ালের পরে আদালতে সরকারের বিড়ম্বনা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেক আইনজীবী।