এই সময়: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে ফের র্যাগিংয়ের অভিযোগ! এবং এই ঘটনায় অভিযোগের তির যাঁদের বিরুদ্ধে, তাঁদের অনেকেই ক্যাম্পাসে চিহ্নিত ‘র্যাগার’। দু বছর আগে প্রথম বর্ষের ছাত্রের ব়্যাগিং, যৌন হেনস্থা ও মৃত্যুতে নাম জড়িয়ে রয়েছে এঁদের অনেকেরই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এঁরা দোষীসাব্যস্ত। কিন্তু আদালতের রক্ষাকবচ থাকায়, কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি ইউনিভার্সিটি।
এ বারের ঘটনায় ঘণ্টা চারেকের বেশি সময় ধরে ফিল্ম স্টাডিজ়ের এক ছাত্রকে ঘরে আটকে রেখে শারীরিক, মানসিক হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। আক্রান্ত ছাত্রের মাকে ধর্ষণের হুমকি থেকে বাঁশি দিয়ে তাঁকে মারধর — বাদ যায়নি কিছু। সেখানেও শেষ নয়। ওই ছাত্রকে দিয়ে ‘কিছুই হয়নি’ মর্মে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। দিতে হয়েচে ফেসবুক পোস্ট। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, ওই র্যাগাররা হস্টেলে থাকলে বাকি আবাসিকরা কতখানি নিরাপদ?
ফিল্ম স্টাডিজ় দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্র অ্যান্টি ব়্যাগিং কমিটির কাছে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁর দাবি, গত মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) মেন হস্টেলের এ ওয়ান ব্লকে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ইফতারের জন্য বিকেলের দিকে বেরিয়ে যান বন্ধুটি। আক্রান্ত ছাত্র তখন ওই বন্ধুর ঘরেই বসেছিলেন। এমন সময়ে অভিযুক্তরা ঘরের মধ্যে তাঁকে কার্যত ঘিরে ফেলেন। শুরু হয় গালিগালাজ। এর আগে ক্যাম্পাসে ব়্যাগিং–কালচারের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন আক্রান্ত ছাত্র। অভিযোগ, তখন থেকেই তিনি ব়্যাগারদের টার্গেট।
মঙ্গলবারের হেনস্থার ঘটনায় ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার এক ছাত্র নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ। এই ছাত্রও আগের বারের ঘটনায় সরাসরি দোষীসাব্যস্ত। অভিযোগ, গত মঙ্গলবার আক্রান্ত ছাত্রের বিভিন্ন পুরোনো ফেসবুক পোস্ট তুলে ধরেন ওই পান্ডা। বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, ফিল্ম স্টাডিজ়ের ওই পড়ুয়া আদতে হস্টেলের সব আবাসিককেই র্যাগিংয়ে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত করতে চান। এর প্রতিবাদ করেন আক্রান্ত ছাত্রটি। তিনি বলার চেষ্টা করেন, পুরো হস্টেলকে তিনি মোটেই দাগিয়ে দিতে চান না। যাঁরা নিয়মিত ব়্যাগিংয়ের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন।
অভিযোগ, এরপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। হামলাকারীরা হাতের কাছে একটি বাঁশি খুঁজে পান। তা দিয়ে চলতে থাকে মারধর। পাশাপাশি আরও এমন অনেককে ডেকে আনা হয়, যাঁরা মেন হস্টেলের আবাসিকই নন। জনা ১০–১২ ছেলে মিলে চালাতে থাকেন নিগ্রহ। আক্রান্তকে দিয়ে ওই মুচলেকা লেখানোর পাশাপাশি ফেসবুকে পোস্ট দিতেও বাধ্য করা হয়। সেখানে তাঁকে লিখতে হয় — ক্যাম্পাসে ব়্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে আগে তিনি যা বলেছিলেন, তার সবই মিথ্যে। প্রথমে এই পোস্ট দিতে রাজি হননি ফিল্ম স্টাডিজ়ের ছাত্রটি। তখনই দোষীসাব্যস্ত ওই র্যাগার আক্রান্তের মায়ের প্রসঙ্গ টেনে ধর্ষণের হুমকি দেন বলে অভিযোগ। এরপর নিগৃহীত ছাত্রটি বাধ্য হয়েই ফেসবুকে পোস্ট করেন।
এতেও মুক্তি মেলেনি। রাত ১০টা পর্যন্ত র্যাগিং চলে। শেষে হস্টেল থেকে বের করার সময়ে হুমকি দেওয়া হয় যে, ঘটনার কথা বাইরে জানালে ‘অন্য ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার আক্রান্ত ছাত্র বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্টি র্যাগিং কমিটির কাছে অভিযোগ করেছি। পুলিশে যাব কি না, সেটা বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করব। এখন আমার কাছে সমঝোতার প্রস্তাব আসছে। কিন্তু আমি চাই, বিশ্ববিদ্যালয় এবং হস্টেল থেকে ব়্যাগিং–কালচার একেবারে নির্মূল হোক।’ উপাচার্য ভাস্কর গুপ্তের বক্তব্য, ‘অভিযোগ পেয়েই তদন্তে নেমেছে অ্যান্টি ব়্যাগিং কমিটি ও স্কোয়াড। আমরা কোনও ভাবেই ব়্যাগিংকে প্রশ্রয় দেবো না।’
বছর দুয়েক আগে ছাত্রমৃত্যুর পরেও র্যাগারদের দাপট কমানো যাচ্ছে না কেন? কখনও র্যাগিংয়ে অসুস্থ ছাত্রকে হাসপাতালে যেতে বাধা দেওয়া, কখনও অভিযুক্তরা মামলা লড়বেন বলে জিবি ডেকে টাকা তোলার মতো অভিযোগ লেগেই আছে। এ সব আটকানো যাবে কী ভাবে? ভিসি–র বক্তব্য, ‘আমরা নানা পদক্ষেপ করেছি। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের জন্য আলাদা হস্টেল হয়েছে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। ঢোকা–বেরোনোর সময়ে রেজিস্টারে নাম লেখা হচ্ছে। কিন্তু দোষীসাব্যস্ত কিছু ছাত্র আইনি রক্ষাকবচ পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপে আমরা অপারগ।’ যদিও হস্টেলের আবাসিক নন, এমন ছেলেরা কী করে ঘটনার সময়ে ওই ঘরে হাজির হয়ে গেলেন, তার সদুত্তর নেই কর্তৃপক্ষের কাছে।
আর শিক্ষক সমিতি জুটা–র সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায়ের আবেদন, ‘আইনের রক্ষকরা বিষয়গুলি নিয়ে একটু ভাবুন। দোষীরা যদি বারবার প্রোটেকশন পেয়ে যায়, তা হলে কখনই ব়্যাগিং–সংস্কৃতি আটকানো যাবে না।’
এমনিতেই গত ১ মার্চ ক্যাম্পাসে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর যাওয়া ও তার পরের গোলমাল ঘিরে শিরোনামে যাদবপুর। তা নিয়ে চাপান–উতোর চলছেই। এ বার ফের র্যাগিংয়ের সূত্রে আলোচনায় চলে এল প্রথম সারির এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।