• বেশি প্রযুক্তি-নির্ভরতাতেই কি ধার কমছে অপরাধের তদন্তে
    এই সময় | ২১ মার্চ ২০২৫
  • এক মাস পেরিয়ে গেল, ধরা পড়ল না এক জনও। বিডন স্ট্রিটের মোড়ে, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের একটি বহুতলে রোগে শয্যাশায়ী এক বৃদ্ধার ফ্ল্যাটে ঢুকে অস্ত্র দেখিয়ে লুটপাট চালায় একদল দুষ্কৃতী। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতের কথা। লুটপাটের আগে দুষ্কৃতীরা বাড়ির বাইরে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছিল, কেটে দিয়েছিল তার–ও। ঘটনার পর কলকাতার খোদ পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা বলেছিলেন, ‘ওই ফ্ল্যাটের খুঁটিনাটি সম্পর্কে দুষ্কৃতীদের কাছে ভিতর থেকে ইনপুট গিয়েছিল।’ কিন্তু কে বা কারা সেই ইনপুট দিল, কারা লুটপাট করল— সে সব কিছুই জানা যায়নি। বড়তলা থানা থেকে তদন্ত চলে গিয়েছে গোয়েন্দা বিভাগের হাতে।

    মার্চের গোড়ায় বিজয়গড় লাগোয়া লায়েলকায় এক ক্যাব চালককে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ ওঠে স্থানীয় কয়েক জনের বিরুদ্ধে। গুরুতর জখম ওই যুবক দিন তিনেক পর হাসপাতালে মারা যান। যাদবপুর থানার পুলিশ এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রেও কি তদন্ত যাবে গোয়েন্দা বিভাগের কাছে?

    সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনায় কলকাতা পুলিশের অন্দরেই একটা প্রশ্ন উঠে আসছে। কেবলই প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা কি চুরি–ছিনতাই–ডাকাতির মতো চিরাচরিত অপরাধ বা ট্র্যাডিশনাল ক্রাইমের দ্রুত কিনারা করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে উঠেছে পুলিশের, বিশেষ করে থানার পুলিশকর্মী ও অফিসারদের কাছে? আগে এ ধরনের অপরাধের একটা বড় অংশের কিনারা করে ফেলত থানাই। সেই জায়গায় এখন পরিস্থিতি প্রায় এমন যে, গোয়েন্দা বিভাগ না–ঢুকলে দুষ্কৃতীরা ধরা পড়ছে না বহু ক্ষেত্রেই।

    কলকাতা পুলিশের পোড় খাওয়া অফিসারদের একাংশ মনে করছেন, ‘অপরাধের কিনারা করার ক্ষেত্রে কেবল সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ, মোবাইল ফোনের কল ডিটেল রেকর্ড, মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনের উপরেই অতিরিক্ত নির্ভর করে সাফল্য পেতে পেতে সোর্স নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে গিয়েছে অনেকেরই।’ ওই অভিজ্ঞ অফিসারদের কথায়, ‘কর্তাদেরও একাংশ সোর্স নেটওয়ার্কের গুরুত্ব বোঝেন না বা বুঝতে চান না। তাঁরা ভাবছেন, শুধু প্রযুক্তি দিয়েই কামাল করা যাবে। তাঁদের ধারণা নেই যে, অপরাধের কিনারা করার ক্ষেত্রে খোচড়রাই আমাদের আসল শক্তি। ফলে, দীর্ঘ সময় ধরে এ দিকটা অবহেলিত হতে হতে যা পরিণতি হওয়ার কথা সেটাই হচ্ছে। থানার সোর্স নেটওয়ার্কের ধার ভোঁতা হয়ে ভেদশক্তি প্রায় হারিয়েই ফেলেছে। ফলে, যখন প্রযুক্তির সাহায্য মিলছে না, তখন আর এগনো যাচ্ছে না।’ বিডন স্ট্রিটের মোড়ে বহুতলে বৃদ্ধার ফ্ল্যাটে লুটপাটের ঘটনায় যেমন সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের সাহায্য মেলেনি।

    লালবাজারের অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, ‘সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে না-হয় দুষ্কৃতীদের মুখ দেখা গেল। কিন্তু তারা এ রাজ্যের নাকি ভিন রাজ্যের গ্যাং, সেটা জানতে হলে সোর্স নেটওয়ার্ককে চাঙ্গা রাখতেই হবে। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ তো আর চোর বা ডাকাতকে খুঁজে বার করে দেবে না।’

    বছর কয়েক আগে ইএম বাইপাস ধরে সরকারি বাসে করে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময়ে এক কলেজ শিক্ষিকার গলা থেকে সোনার হার ছিনতাই হয়। সকালে যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটে, সেটি প্রগতি ময়দান থানা এলাকার মধ্যে। সে দিনই বিকেলের মধ্যে সোনার হার সমেত দুষ্কৃতী ধরা পড়েছিল। প্রগতি ময়দান থানা এলাকার সেই সময়কার ওসি দীর্ঘদিন গোয়েন্দা বিভাগের ছিনতাই দমন শাখার অফিসার ছিলেন। তাঁর সোর্স নেটওয়ার্কই ধরিয়ে দিয়েছিল ছিনতাইবাজকে। থানার অফিসার গোয়েন্দা বিভাগ অর্থাৎ ডিডি-তে কিংবা ডিডি-র অফিসার থানায় যাচ্ছেন, কলকাতা পুলিশের পোস্টিংয়ে এমন রদবদল হয়েই থাকে। প্রগতি ময়দান এলাকার সেই ঘটনার মতো তাতে সুবিধে যে একেবারেই এখন পাওয়া যাচ্ছে না, তা কিন্তু নয়।

    তবে কলকাতা পুলিশের তাবড় অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, ‘চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী, অফিসারদের একাংশকে মেড ফর ডিডি এবং আর একটি অংশকে মেড ফর থানা ধরে নেওয়া হয়। তাঁদের একটা বড় অংশের ক্ষেত্রে ওই রদবদল হয় না। এখন ডিডি-র অফিসারদের তা-ও কিছুটা সোর্স নেটওয়ার্ক রয়েছে। কিন্তু মোটের উপর থানায় সে দিকটা অবহেলিত। তারই খেসারত দিতে হচ্ছে।’

    লালবাজারের এক কর্তা বলছেন, ‘বহু অপরাধের তদন্তেই গোয়েন্দা বিভাগের সহযোগিতা নেয় থানা। গোয়েন্দা বিভাগও থানাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় নিজে থেকেই। তবে এটাও ঠিক যে, নিজেরা কেস নেওয়া আর থানাকে সহযোগিতা করা, এই দুয়ের মধ্যে তফাত আছে।’

  • Link to this news (এই সময়)