এই সময়: অনেক দিনের টানাপড়েন শেষে এসেছিল সন্ধির বার্তাও। এরই মধ্যে হঠাৎ কলকাতা হাইকোর্টের একটি নির্দেশকে কেন্দ্র করে ফের টলি পাড়ায় কলাকুশলীদের সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অফ ইর্স্টার্ন ইন্ডিয়া’ বা ফেডারেশনের ‘খামখেয়ালি’ নিয়ম–কানুন নিয়ে দ্বন্দ্ব নতুন করে সামনে এলে।
এক স্বাধীন পরিচালকের করা মামলার প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট জানিয়েছে, কোনও ভাবেই ফেডারেশন কোনও পরিচালক বা অভিনেতার কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তাঁদের কাজও বন্ধ করার কোনও এক্তিয়ার নেই ফেডারেশনের। ফেডারেশনের নানা খামখেয়ালি নিয়ম–কানুন, কাজে বাধা দেওয়ার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেন স্বাধীন পরিচালক বিদুলা ভট্টাচার্য। তিনি রাজ চক্রবর্তী প্রযোজিত ‘প্রেম আমার ২’–এর পরিচালক।
বিদুলার অভিযোগ, ফেডারেশনের গা–জোয়ারি, যখন তখন শুটিং বন্ধ করা, কলাকুশলীদের কাজে না পাঠানোর মতো একাধিক কারণে তাঁর দুটি প্রস্তাবিত সিনেমার প্রোডিউসার পিছিয়ে গিয়েছেন। এই ‘অব্যবস্থা’র বিহিত চেয়েই তিনি বছরের শুরুতে হাইকোর্টে মামলা করেন। বৃহস্পতিবার বিচারপতি অমৃতা সিনহার নির্দেশ, ফেডারেশন কোনও ভাবেই কারও কাজে বাধাদান করতে পারবে না। ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের বক্তব্য, ‘আমি আদালতের নির্দেশের কপি পড়েই যা বলার বলতে পারব।’
এর আগে পরিচালকদের ৬০ শতাংশই যৌন নিগ্রহে জড়িত বলে মম্তব্য করেছিলেন স্বরূপ। তা নিয়ে স্বরূপের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের হয়। এই প্রসঙ্গও উঠে আসে আদালতের চলতি মামলায়। সরকারি আইনজীবীর কাছে বিচারপতি জানতে চান, কেন পরিচালকদের আনা অভিযোগ রাজ্য সরকার খতিয়ে দেখেনি? আদালত সূত্রের খবর, আইনজীবীর কাছে এর সদুত্তর ছিল না। তিনি জানান, ৩ এপ্রিল আগামী শুনানিতে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
বিদুলা জানাচ্ছেন, ফেডারেশনের দাপটে তাঁদের নাভিশ্বাস দশা। তাঁর কথায়, ‘আমার মতো ছোট, স্বাধীন পরিচালকদের অবস্থা আরও খারাপ। অনেক কষ্ট করে প্রযোজক জোগাড় করি। সংগঠনের নিয়মের ধাক্কায় তাঁরা চলে যান।’ বিদুলার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। তাই আদালতের দ্বারস্থ হন। তাঁর প্রশ্ন, ‘আমরা স্বাধীন ভাবে কাজ করব, সেটাই দস্তুর। সারা দেশ সেই নিয়মেই চলে। ব্যতিক্রম বাংলা।’ তাঁর মতে, দেশের যে মূল সংগঠন, সেই জাতীয় ফেডারেশনের কথাও বাংলার ফেডারেশন শোনে না!
ঠিক কোথায় সমস্যা?
বিদুলা জানাচ্ছেন, একটি শুটিংয়ে কত জন কলাকুশলী লাগবে সেটা ঠিক করে দেয় ফেডারেশন। এতজন লোক না লাগলেও ফেডারেশনের চাপে তা নিতেই হয়। অনেককেই বসিয়ে বসিয়ে পারিশ্রমিক দিতে হয়। এমনকী একজন পরিচালকের এই স্বাধীনতাটুকু নেই যে তিনি নিজের মতো ক্যামেরা কী লাগবে সেটা ঠিক করবেন। কতজনকে নিয়ে আউটডোরে যেতে হবে তার সংখ্যাও ফেডারেশন ঠিক করে দেয়। এমনই সব অভিযোগ নিয়ে তিনি হাইকোর্টের দ্বারস্থ। তাঁর কথায়, ‘জানি এরপরে নানা সমস্যা হতে পারে। হয়তো কাজ পাব না। এখনও হাতে কাজ নেই। কিন্তু এটা আমার নৈতিক লড়াই।’
এর আগে ফেডারেশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন পরিচালক–প্রযোজকদের একটা বড় অংশ। গত বছরের মাঝামাঝি পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়ের শুটিং বন্ধ করার অভিযোগ ওঠে ফেডারেশনের বিরুদ্ধে। তারপরে দীর্ঘদিন কর্মবিরতি চলে। তাতে অংশ নেন টলিগঞ্জের প্রথম সারির পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতারা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, পরিচালক গৌতম ঘোষরা এই অচলাবস্থা কাটান। ঠিক হয়েছিল, একটি কমিটি গঠন করা হবে। সেই কমিটি সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে টলি পাড়ার এই সব নিয়ম–কানুনের অবসান ঘটাবে।
অভিযোগ, তারপরে অনেকগুলো মাস কেটে গেলেও সেই কাজ এগোয়নি। গত বছরের শেষের দিকে পরিচালক–অভিনেতা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্যরা ফেডারেশনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু বছর শেষ হতেই সেই তপ্ত আবহাওয়ার বদল হয়। ফিরে আসে ‘সুসম্পর্ক’–র আবহ। পরমব্রতর বক্তব্য, ‘আমরা ফেডারেশনের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু ফেডারেশনের চলন পদ্ধতি অনেকদিন ধরেই তার সাংবিধানিক এক্তিয়ারের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। সেই বিষয়গুলি নিয়ে সরব হওয়ায় আমাদের অনেককেই বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। এখনও হচ্ছে। এই বিশেষ মামলাটির বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। তবে আদালত যে এই বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বিদুলা বলছেন, ‘বড় পরিচালকদের অনেকে হয়তো বাধ্য হয়েই ফেডারেশনের এই সব নিয়ম–কানুন মেনে নিচ্ছেন। আমি কেন মামলা করেছি — তা নিয়েও কথা শোনাচ্ছেন। বলছেন, আমার মামলার জন্য নাকি ফেডারেশন আলোচনায় বসতে রাজি হচ্ছে না। আমার কোনও উপায় ছিল না।’ নাম না করে পরিচালকদেরই অনেকের বিরুদ্ধে ‘শিবির–বদল’ করার অভিযোগে সরব বিদুলা। পরিচালক সংগঠনের সভাপতি সুব্রত সেন বলেন, ‘আমি বিদুলাকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না। এই বিষয়টিও তেমন জানা নেই।’