• দিঘায় প্রবাল-খেকো মাছ, প্রবাল প্রাচীর কি কাছেই? কী বলছে গবেষণা?
    এই সময় | ২১ মার্চ ২০২৫
  • সুমন ঘোষ, খড়্গপুর

    দিঘায় এখন প্রায়ই মিলছে প্রবাল–খেকো মাছ। এই মাছ সমুদ্রের প্রবাল খেয়ে বেঁচে থাকে বলেই স্থানীয় বাবে এগুলোকে এই নামে ডাকা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কোরাল আইল্যান্ড বা প্রবাল প্রাচীরের আশপাশে ঘুরে বেড়ানো মাছেরও দেখা মিলছে এই দিঘাতেই। কিন্তু সেই মাছ দিঘায় এলো কী করে? দিঘার মোহনা থেকে যে সমস্ত জেলেরা সমুদ্রে মাছ ধরতে যান, তাঁদের জালেই ধরা পড়েছে এমনই সব রকমারি মাছ।

    আরও প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলে, অর্থাৎ দিঘার অদূরে প্রবাল প্রাচীরের অস্তিত্ব রয়েছে? বিষয়টি ‍নিয়ে সমুদ্রবিজ্ঞানীরা ও জীববিদ্যার গবেষকেরা ধন্দে। ইতিমধ্যেই তাঁরা ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন। তবে প্রাথমিক ভাবে তাঁদের ধারণা, দিঘার অদূরে প্রবাল প্রাচীর থাকার সম্ভাবনা তেমন না থাকলেও ছোট ছোট প্রবাল থাকার সম্ভাবনা প্রবল।

    তাঁদের বক্তব্য, প্রবাল না থাকলে এই মাছ থাকতে পারে না। এর পিছনে আরও একটি প্রমাণ হল, জেলেদের জালে এই মাছের সঙ্গে ছোট ছোট প্রবালও মিলেছে। গবেষকেরা আরও একটি বিষয়ে নিশ্চিত। তা হল, দিঘার সমুদ্রে প্রবাল জন্মানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, সে জল অতি মাত্রায় কর্দমাক্ত। প্রবাল জন্মানোর প্রথম শর্তই হল স্বচ্ছ দূষণমুক্ত জল, যা ভেদ করে সূর্যের আলো পৌঁছতে পারে একেবারে নীচে।

    এ ধরনের জলেই জন্ম নেয় প্রবালের মতো সামুদ্রিক প্রাণী। তবু দিঘার সমুদ্রে বিগত কয়েক বছর ধরেই মিলছে এই মাছ। দিঘায় যে সব প্রবাল–খেকো মাছ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলির বৈজ্ঞানিক নাম স্ক্যারাস ঘোব্বান (Scarus ghobban)। এর আর একটি নাম হল প্যারট ফিশ। এটি রুই মাছের মতো দেখতে বলে স্থানীয় জেলেরা সামুদ্রিক রুইও বলে থাকেন।

    দিঘা মোহনা থেকে যে সমস্ত জেলেরা সমুদ্রে মাছ ধরতে যান, তাঁদের জালেই ধরা পড়ে এগুলো। এ নিয়ে ২০১১ সালে একটি গবেষণাও করেছিলেন জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার হায়দরাবাদের ফ্রেশওয়াটার বায়োলজি রিজিওনাল সেন্টারের গবেষক প্রসন্ন ইয়েন্নাওয়ার এবং দিঘার মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম রিজিওনাল সেন্টারের গবেষক প্রসাদচন্দ্র টুডু, দীপাঞ্জন রায় এবং অনিল মহাপাত্র। বস্তুত, সে সময়েই প্রথম দিঘার মোহনায় এই মাছের অস্তিত্ব মেলে।

    দীপাঞ্জনবাবু এখন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বাজকুল কলেজের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক।সামুদ্রিক মাছ নিয়েই গবেষণা করেন। তিনি দেখেন, স্ক্যারাস ঘোব্বান-সহ আরও কয়েকটি মাছের সন্ধান মিলেছে ইদানীং। এই মাছগুলি সাধারণত প্রবাল বা প্রবাল প্রাচীরের আশপাশে ঘোরাফেরা করে। সেগুলি হল মোরে ইল্্‌স, ফ্লাইং গার্নার্ডস, স্করপিয়ন ফিশ, সি রবিন, অ্যাঞ্জেল ফিশ, বাটারফ্লাই ফিশ, স্কুইরেল ফিশ। দীপাঞ্জনবাবু জানান, সব থেকে বেশি মেলে স্ক্যারাস ঘোব্বান।

    জেলেরা জানিয়েছেন, সমুদ্রতট থেকে অদূরে জলের নীচে লাল, সাদা নানা রকম ফুলের মতো রয়েছে। সেখান থেকেই এই মাছ মেলে। দীপাঞ্জনবাবুর কথায়, ‘যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় এখানকার জেলেরা যেখানে মাছ ধরেন সেখানে প্রবাল রয়েছে। ১৯৯০ সালে ওড়িশার গঞ্জামে ডুবন্ত প্রবাল দ্বীপের সন্ধান মিলেছিল। এ বার তা ধীরে ধীরে অন্যত্রও ছড়াতে পারে। তবে সঠিক তথ্য জানতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।’

    জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার গবেষক অনিল মহাপাত্র বলেন, ‘গোপালপুরের দিকেও কিছু প্রবাল রয়েছে। তবে প্রবালদ্বীপের রয়েছে এমন তথ্য মেলেনি। বাংলাদেশের দিকেও কিছু জায়গায় প্রবাল রয়েছে। দিঘার জেলেরা তো অনেক সময় মাছ ধরতে ধরতে বাংলাদেশও চলে যায়। আবার গোপালপুর, পুরীর উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে কোত্থেকে এই মাছ ওদের জালে উঠলো সে নিশ্চিত হতে হবে।’

    অনিলবাবুর মতেও, দিঘার সমুদ্রে প্রবাল জন্মানো কঠিন। কারণ, একাধিক নদী থেকে জল সমুদ্রে ঢোকায়, সমুদ্রর জলে কাদার পরিমাণ বেশি। ফলে তাপমাত্রা প্রবাল তৈরির উপযুক্ত থাকলেও সূর্যের আলো যেহেতু জলের নীচে পৌঁছতে পারবে না, ফলে প্রবাল জন্মানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। গবেষকরা জানাচ্ছেন, সমুদ্রের নীচে কোরাল থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। যা দেখে প্রথমেই বোঝা যায়, জলে দূষণ কম। আর প্রবালের সঙ্গে থাকবে রকমারি মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী। পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণ বাড়বে। সামুদ্রিক ঢেউও অনেকটা আটকাতে পারে প্রবাল প্রাচীর। ফলে উপকূলে ভাঙনও অনেকটা কমবে। সুনামিতেও একইভাবে ঢেউয়ের বেগ কমাতে সক্ষম। দীপাঞ্জনবাবুর মতে, এই বিষয়ে বিশদ গবেষণা জরুরি।

  • Link to this news (এই সময়)