সুদীপ মাইতি
'কোন যুগ থেকে এই অঞ্চলে পুতুলনাটকের শুরু তা বলতে পারব না। তবে বংশ পরম্পরায় আমরা এই পুতুলনাটক করে আসছি। আমাদের এই পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুর ২ ব্লকের পদ্মতামলি গ্রামে এক সময়ে ৭০-৮০টি পরিবারের বেশী পুতুলই ছিল বেঁচেবর্তে থাকার প্রধান উপায়। জেলা ছাড়িয়ে ভিন জেলায় এই পুতুলনাটকের মাধ্যমে বিনোদন ও শিক্ষামূলক বিষয়ে সচেতনতা কাজ করে গিয়েছেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা। তবে আজ সেই শিব- দুর্গা, রাজা-রানি, বুড়ো-বুড়ি, শাশুড়ি-বৌমা, প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা পুতুলরা সব ব্যাগবন্দি। বছরে দু একবারও তাদের বাইরে আনতে কেউ ডাকে না। পেশা হিসাবে তাই এগুলো আজ ব্রাত্য। এখন এই গ্রামে দশটি পরিবারও এই গৌরবময় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত নেই। টিমটিম করে যাঁরা রয়েছেন এটি আর তাঁদের আর কারও পেশা নয়। তাই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের বড় প্রাণের এই জীবিকা।'
২১ মার্চ বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবসের প্রাক্কালে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন ৬৫ বছরের বসন্ত ঘোড়াই। স্বামী-স্ত্রী মিলে ঘরের এক কোণে চায়ের দোকান দিয়েছেন। ক্রেতা সামলাতে সামলাতে তিনি বলছিলেন, 'এই লোকসংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনও উদ্যোগ নেই। আগে এই বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবসে কলকাতার রবীন্দ্র সদনে আমরা শো করে এসেছি। এ বারে ২১ মার্চের কথা আপনি মনে করালেন। গ্রাম থেকে জেলা বা শহরে কোথাও ডাক নেই।'
বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবসের আগে পদ্মতামলি গ্রামে পৌঁছে জানা গেল, এখানে একদিন পুতুলনাট্যের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের নিয়ে রাজ্য সম্মেলন হয়েছিল। সেই ঢেউ আজ স্তিমিত। হারিয়ে যাওয়া মুরারীমোহন ঘোড়াই, ইন্দ্রনারায়ণ ঘোড়াই, নীলমণি ঘোড়াই, খগেন্দ্রনাথ ঘোড়াইদের দেখানো পথে বসন্ত ঘোড়াই, বিষ্ণুপদ ঘোড়াই, অরবিন্দ ঘোড়াই, অমল ঘোড়াই কিংবা জাপানে শো করে আসা রামপদ ঘোড়াইরা আজ টিমটিম করে পুতুলনাটকের আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন। অরবিন্দ ঘোড়াইয়ের কথায়, 'ভবিষ্যৎ নেই জেনেও পাড়ার ছোটদের শেখাচ্ছি।'
পদ্মতামলি গ্রামটি মূলত দস্তানা পুতুল বা বেণী পুতুলের গ্রাম বলে পরিচিত। হাতে দস্তানা পরে তর্জনী, অনামিকা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সাহায্যে এক হাতে বা দু'হাতে দু'টি পুতুল নিয়ে পুরাণ, লোককাহিনি বা স্থানীয় সমস্যা সম্পর্কিত দুঃখ-কষ্ট নিয়ে স্বরচিত গান শোনাতেন শিল্পীরা। এ ছাড়া এই জেলারই আশেপাশে
দু'চারটি গ্রামে দণ্ড-পুতুলও দেখতে পাওয়া যায়। ইংরেজিতে রড-পাপেট বা স্থানীয় ভাষায় ডাং পুতুল কিংবা দণ্ড-পুতুলও বলে। যদিও এই দন্ড-পুতুল দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন লাগোয়া অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। পুতুলের দু'টি হাতে যুক্ত থাকা লোহার শিককে শিল্পী হাতে ধরে, পালার সংলাপ ও গান অনুসরণ করে পুতুলকে নাচায়। বেণী পুতুল, দণ্ড পুতুল ছাড়াও মূলত রাজস্থান এবং কেরালায় সুতো-পুতুল কিংবা দক্ষিণী ঘেঁষা রাজ্যগুলিতে ছায়া পুতুলও দেখতে পাওয়া যায়। আবার ঝাড়খণ্ড লাগোয়া কিছু এলাকায় পুতুলনাচকে চাদর বধিনি বা স্থানীয় ভাষায় চদর বদরও বলা হয়।
ইতিহাস বলছে, সম্রাট অশোকের সময়ে এই পুতুলনাট্যকলা ব্যবহার করে বুদ্ধের জীবনী ও বাণী প্রচার করে সাম্রাজ্য বিস্তার ও প্রশাসনিক কাজ করা হতো। আবার অন্য তথ্যটি হলো, প্রায় তিন হাজার বছর আগে তাহলিপ্ত ও সপ্তগ্রাম বন্দরের বাঙালি বণিকদের হাত ধরে পুতুলনাট্যকলা তার বর্ণময় বিনোদন সম্ভার নিয়ে বিদেশে পৌঁছে গিয়েছিল। হাজার হাজার বছর ধরে পুতুলনাটক নিয়ে বিভিন্ন ধরনের চর্চার পরে এ-ও আজ সত্য যে, জনসচেতনতার কাজে পুতুলনাটক খুব বড় এবং শক্তিশালী হাতিয়ার।
পুতুলনাটক নিয়ে বহুদিন কাজ করে চলা বিশিষ্ট নাট্যকার শুভজোয়ারদারের কথায়, 'ভারতের রাঢ়বঙ্গের 'পোতলাবাজি'ই যে আজ বিশ্ব পুতুলনাট্যকলার জননী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর আমাদের থেকে শিখে বিদেশিরা কিন্তু পুতুলের অনেক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে পুতুল নাট্যকলার পাঠক্রম। আমরা যেখানে শিল্পী ও শিল্পটিকে বাঁচাতে ব্যস্ত, সেখানে বিদেশে শিল্পটির সহায়তায় রাষ্ট্রের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিজ্ঞান, বিপণন-এক কথায় সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়েছে।
বস্তুত জন্মভূমিতেই অবহেলিত আমাদের বর্ণময় এই লোকশিল্পটি। অথচ ইউএনও-এর মতে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশের প্রধান সমস্যা হলো অসচেতনতা। মানুষকে সচেতন করার শ্রেষ্ঠ উপায় হতে পারত এই পুতুলনাটক। আমরা স্বাধীনতার এতগুলো জয়ন্তী পার করেও আজ পর্যন্ত দেশের একটি শহরেও সব ধরনের পুতুলনাটক পরিবেশনের উপযোগী একটিও প্রেক্ষাগৃহ বানাতে পারিনি। স্কুল কলেজ তো দূরস্থান, এমনকী আমাদের পারফর্মিং বিশ্ববিদ্যালয়েও পুতুলনাটকের কোনও পাঠ্যক্রম নেই।'
ফিরে আসি বসন্ত ঘোড়াইয়ের স্বরচিত গানের কথায়। আজকের সমাজের বাস্তবিক দিক দেখে তিনি বলেন, 'ধর্ম নিয়ে বিভাজনের ঢেউয়ে তো সাধারণ মানুষই মারা যায়। এ সব দেখে সেই ১৯৯২ সালে লিখেছিলাম সব জাতি তো মানুষ রে ভাই ভিন্ন কোনও কিছুই নয়/রক্ত মাংস দিয়ে গড়া, মাটির তৈরি পুতুল নয়/হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন যতেক মানুষ ভাই/সবার গায়ে লাল রক্ত, কালো কারও নয়/তাই মিলেমিশে থাকলে পরে ঐক্য সমাজ গড়া যায়।'
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)