• সব আশ্বাস বিফলে, জল সঙ্কটে নাজেহাল জনগণ
    এই সময় | ২৩ মার্চ ২০২৫
  • সুপ্রকাশ চক্রবর্তী, হাওড়া

    আবহাওয়া দপ্তরের আগাম পূর্বাভাসে অনেকেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন। শনিবার সকাল থেকে দফায় দফায় মুষলধারে বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস ছিল। হাওড়ার মানুষরা ভেবেছিলেন, বৃষ্টি হলে সেই জল জমিয়ে রেখেই অন্তত এক দু’দিনের সমস্যা মিটবে। তাই ভোর থেকেই বাড়ির ছাদে বালতি, গামলা ও বাটি রেখে আসেন বহু পরিবার। কিন্তু দিনভর চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকলেও এক বিন্দু জল মেলেনি। তাই পরিস্থিতি যে তিমিরে ছিল সেই অবস্থায় রয়ে যায় হাওড়ায়।

    তিন দিন কেটে গেলেও এখনও স্বাভাবিক হয়নি হাওড়া পৌরসভার বিস্তীর্ণ এলাকার পানীয় জল সরবরাহ। হাওড়া পৌরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান সুজয় চক্রবর্তী শুক্রবার সাংবাদিক সম্মেলনে করে জানিয়েছিলেন যে, শুক্রবার রাতের মধ্যেই মধ্য হাওড়া এবং শিবপুরের যে কয়েকটি ওয়ার্ডে পানীয় জল সরবরাহ হচ্ছে না, সেখানে বিকল্প পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানীয় জল পাঠানো হবে।

    কিন্তু শনিবার সকাল থেকে দেখা গেল, সেইসব জায়গাতেও জল আসেনি। কোনও কোনও জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে পানীয় জল এসেছে, কিন্তু তার পরে আর সেখানে জল পাওয়া যায়নি। অন্য দিকে, বামুনগাছি এবং উত্তর হাওড়ার সালকিয়া, বেলগাছিয়া–সহ বিস্তীর্ণ এলাকা পুরোপুরি নির্জলা।

    এইসব জায়গায় হাওড়া পৌরসভার সরবরাহ করা পানীয় জল পৌঁছয়নি। চেয়ারম্যান জানিয়েছিলেন, এলাকায় পাইপলাইনে জল আসতে দু-তিন দিন সময় লেগে যাবে। কারণ, বেলগাছিয়া থেকে কেএমডিএ–র একটি বিকল্প পাইপলাইন উত্তর হাওড়ায় দ্রুত গতিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

    কিন্তু তার বদলে এইসব জায়গায় পর্যাপ্ত জলের ট্যাঙ্কার পাঠানোর কথা। কিন্তু শনিবার সকাল থেকে দেখা গেল, জলের ট্যাঙ্কার পর্যাপ্ত নয়। ট্যাঙ্কার আসার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বহু মানুষ আগে থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। নিমেষের মধ্যে সেই জল শেষ হয়ে যায়। মানুষ বাধ্য হয়ে বোরিং ওয়াটারের জল বা বিভিন্ন কোম্পানির জল তিন গুণ বেশি দামে কিনে চালাচ্ছেন।

    পরিস্রুত যে ফিল্টার ওয়াটার দোকানে বিক্রি হয়, বেশিরভাগ দোকানে সেই জল নেই। কোথাও সেই জল পাওয়া গেলেও, ডবল দাম নেওয়া হচ্ছে। এক লিটারের জল ২০ টাকার জায়গায় ৪০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। অন্য দিকে, মধ্য হাওড়া এবং শিবপুরের যে সব জায়গায় জল সরবরাহ এখনও স্বাভাবিক আছে, সেইসব জায়গা থেকেই কিছু মানুষ ২০ লিটারের জারে করে জল এনে এইসব জায়গায় বিক্রি শুরু করেছেন চড়া দামে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ খুবই দুর্বিষহঅবস্থার মধ্যে রয়েছেন।

    শনিবারও দেখা গেল, পৌরসভার আধিকারিকরা বেলগাছিয়া ভাগাড়ের পাইপলাইনের মেরামতি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বেলগাছিয়া থেকে কেএমডিএ–র বিকল্প পাইপলাইন দ্রুত উত্তর হাওড়ায় পৌঁছনোর কাজ শুরু হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের অভিযোগ, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, পৌরসভা মুখে যা–ই বলুক, এখনও বেশ কয়েকদিন এই জল–যন্ত্রণায় ভুগতে হবে এলাকার মানুষকে।

    তবে বিভিন্ন জায়গায় জনপ্রতিনিধিরা বোরিং ওয়াটারের জল তুলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণের কাজও শুরু করেছেন। উত্তর হাওড়ার বিধায়ক গৌতম চৌধুরী, মধ্য হাওড়ার প্রাক্তন তৃণমূল নেতা বিভাস হাজরা, এঁদের সেইসব বোরিং ওয়াটারের জল বিতরণ করতে দেখা যায়। বাসিন্দারা অবশ্য জানিয়েছেন, তা–ও পর্যাপ্ত নয়। পৌরসভার উচিত আরও বেশি করে ট্যাঙ্কার পাঠানো, যাতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।

    হাওড়া সিটি পুলিশের একটি টিম মাইক নিয়ে সকাল থেকেই বাসিন্দাদের ধস এলাকা থেকে সরে যেতে বলে। পরে তাঁদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়। অন্য দিকে, বেলগাছিয়া ভাগাড়ের কাছে রাস্তায় ধস নেমে নিকাশি নালার কিছুটা অংশ বসে যাওয়ায়, বেশ কয়েকটি জায়গায় জল নিকাশিও বাধা পাচ্ছে। কিছু জায়গায় জল জমে গিয়েছে। বামুনগাছি এবং সালকিয়ায় যাঁদের বোরিং মেশিন রয়েছে, সেখান থেকে বোরিং করে জল স্থানীয় বাসিন্দাদের দেওয়া হচ্ছে। অনেক আবাসন থেকে এই বোরিং মেশিনের জল চার থেকে পাঁচ গুণ দামে বিক্রি করা হচ্ছে বাসিন্দাদের।

    স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই জলের অভাবে এলাকা ছাড়তে শুরু করেছেন। এ দিন সকাল থেকেই বেলগাছিয়া মোড়ে নতুন পাইপলাইন বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। সেই পাইপলাইনের কাজ শেষ হলে উত্তর হাওড়া বাসিন্দারা পানীয় জল পাবেন। এমনটাই জানিয়েছে হাওড়া পুরসভা।

    শনিবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তরের মন্ত্রী অরূপ রায় কাজের অগ্রগতি সরজমিনে দেখতে আসেন। এ দিন তিনি বলেন, ‘একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে, যার ফলে পুরসভার জল সরবরাহ ব্যাহত হয়। শিবপুর এবং মধ্য হাওড়া এলাকায় জল সরবরাহ শুরু হলেও উত্তর হাওড়ায় এখনও তা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন পৌরসভা থেকে জলের গাড়ি এনে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’

    কিন্তু সত্যি কি যাবতীয় বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃতিই দায়ী? স্থানীয় বাসিন্দারা কিন্তু সেটা মানতে নারাজ। এ দিন দুপুরে বেলগাছিয়া ভাগাড় এবং তার আশপাশের বাসিন্দারা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

  • Link to this news (এই সময়)