অশোক মাহাতো
আমাদের ঝাড়গ্রাম ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বতর্মান রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। এই জেলার নয়াগ্রাম থেকে বেলপাহাড়ি পযর্ন্ত রয়েছে শাল-জঙ্গল ঘেরা জেলার সীমানা। জেলা ছোট হলেও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ধারক-বাহক এই জেলা। ফলে ঝাড়গ্রাম এখন পর্যটন জেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। জেলার একমাত্র শহর, তার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে একটি রাজ্য সড়ক যা জাতীয় সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত। এ ছাড়াও শহরের উপর দিয়ে গিয়েছে ট্রেন লাইন। যদিও ট্রেন পরিষেবা নিয়ে মানুষের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।সালটা ২০০৮।
ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে ভর্তি হয়েছি। আর কলেজ মানেই ছাত্র রাজনীতি। ঘটনাক্রমে সেই বছরেই আবার ঝাড়গ্রাম পুরসভার নির্বাচন। শুরু হলো রাজনীতি সম্পর্কে একটু একটু করে জানা। যদিও সেই সময়ে রাজনৈতিক আলোচনা এতটা হতো না। আমাদের বয়সের বেশিরভাগ ছেলেরা মাঠমুখি ছিল আর বাকি সময়টা পড়াশোনা। ঝাড়গ্রাম পুর-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক চর্চা শুনতে লাগলাম। দেওয়াল লিখন আর মিটিং মিছিল নজরে পড়লেই একটু দেখতাম এবং বোঝার চেষ্টা করতাম। দেওয়াল লিখনে উল্লেখ থাকত শান্তি ও উন্নয়ন শব্দ দু'টি। তখন মনে হতো, এদের ভোট দিলে বুঝি এলাকায় শান্তি ও উন্নয়ন বজায় থাকবে। তবে দেওয়াল লিখন আর বাস্তবের রাজনীতি সম্পূর্ণ মেলে না। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর শালবনিতে একটি কারখানা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে তাঁর কনভয় হামলাকে কেন্দ্র করে নতুন এক রাজনৈতিক চিত্র তৈরি হয়। পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলেও সেই খবর উঠে আসে। শুরু হয় পুলিশি তল্লাশি। এই তল্লাশির সময়ে তাঁদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের উপরে পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে এবং গড়ে উঠে 'পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জন সাধারণের কমিটি'।
এখান থেকেই শুরু হয় 'লালগড় আন্দোলন'। সেই সময়ের বিখ্যাত ঝুমুর গান 'কেমনে আইল আকাল ঝড় হইদকে উঠে লালগড়'। লালগড় আন্দোলন ঝাড়গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে রাজ্য ও দেশের রাজনীতিতে চর্চার স্থান করে নিল। শাসকের বিরুদ্ধে উঠল বঞ্চনা, মিথ্যা মামলা, অত্যাচার ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার মতো নানা অভিযোগ। চেনা ঝাড়গ্রাম তখন অচেনা হতে লাগল। রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে প্রশাসনিক ও মিডিয়া প্রতিনিধিদের আনাগোনা বাড়ল। আমরা সরাসরি টিভি চ্যানেলে দেখছি, পার্টি অফিস ভাঙচুর এবং যার নেতৃত্ব সামনে থেকে স্থানীয় মানুষ দিলেও তাঁদের পিছনে এই বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শ এবং সেই রাজনৈতিক আদর্শের নেতৃত্ব কিন্তু এই এলাকার বা এই রাজ্যের নয়। তিনি আবার সাংবাদিক সম্মেলন করতেন অস্ত্র হাতে এবং জনগণের আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করতেন।
এ বার এক নতুন আতঙ্ক গ্রাস করছে এলাকায়। জনগণের অবস্থা 'ডাঙায় বাঘ জলে কুমির'র মতো। শুরু হলো পাল্টা তৎকালীন শাসক নেতৃত্ব এবং কর্মীদের উপরে আক্রমণ এবং অনেকে খুনও হলেন। যাঁরা খুন হলেন তাঁরা কেউ জাতীয় ও রাজ্য স্তরের নীতি নির্ধারক নন। অন্য দিকে, শাসকের পাল্টা আক্রমণেও মৃত্যু হয় অনেকের। শাসক, বিরোধী, পুলিশ ও সাধারণ জনগণ সকলেই আক্রমণের স্বীকার।
চেনা মুখগুলো তখন ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে যাচ্ছে। নিজেরাই নিজেদের কখন শত্রু হয়ে উঠেছে সেই খেয়াল নেই। তৎকালীন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার যৌথ উদ্যোগে এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে বেশ কিছু পদক্ষেপ করল। এই আন্দোলন-সহ রাজ্যের বিভিন্ন আন্দোলনের সংযোগে রাজ্যের মানুষ ২০১১ সালে সরকারের পরিবর্তন করল। গঠিত হলো নতুন সরকার। এই আন্দোলন থেকে ঝাড়গ্রামের ভালো-মন্দ কিছু প্রাপ্তিও হলো। পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সে দিনের ঝাড়গ্রাম মহকুমা আজ জেলায় পরিণত হয়েছে। আন্দোলনের এলাকায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। পরিকাঠামো, উন্নয়ন আগের তুলনায় অনেক বেশি হয়েছে। তবে যে অভিযোগগুলোকে কেন্দ্র করে একটা সময়ের আন্দোলন সেই সব অভিযোগ কি আর নেই? এমনটা বলা যাবে না। শোষণ ও বঞ্চনাহীন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। আজও বঞ্চনা আছে।
শাসকের বিরুদ্ধে বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার চেষ্টার অভিযোগ আছে। দুর্নীতির অভিযোগ আছে। পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ আছে। মিথ্যা মামলার অভিযোগ আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রোজগার-সহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সামাজিক দাবি আছে। ভাষা ও সংস্কৃতি বাঁচানোর ও স্বীকৃতির দাবি আছে। ঝাড়গ্রামের রাজনীতিকে কলকাতা বা দিল্লির নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ আছে। স্বশাসনের দাবি আছে। আত্মপরিচিতির দাবি আছে। আজও ঝাড়গ্রাম ঝাড়গ্রামের স্বকীয়তা রক্ষার লড়াই করে চলেছে।
ঝাড়গ্রামের শাল-জঙ্গল ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভাবে নষ্ট হচ্ছে। দূষণ বাড়ছে। ঝাড়গ্রামের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চুয়াড় বিদ্রোহ থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলোন, নেতাজির আগমন, স্বাধীনতার পরে কৃষক আন্দোলন, বাম আন্দোলন, ঝাড়খণ্ড আন্দোলন। এই রাজনীতির আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে চলে আসছে একটা সমান্তরাল সামাজিক আন্দোলন। সময় বদলেছে। পরিস্থিতি ও পরিবেশ বদলেছে। বদলায়নি ব্যবস্থা। আজ নতুনদের কাছে রাজনীতির মূল উৎস হোক আরও ভালো পরিষেবার জন্য নীতি তৈরির গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। সময় লাগবে তবে অসম্ভব নয়। সশক্ত ভারত তৈরি করতে হলে নিশ্চিত ভাবে সশক্ত নাগরিক তৈরি করতে হবে। সশক্ত ভারত নির্মাণে আগামীর রাজনীতিতে ঝাড়গ্রাম সামনের সারিতে থাকবে কি না তা সময় বলবে!
(পেশায় সমাজকর্মী। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)