দূষণের মাত্রা অনেক বেশি, শ্বাস নেওয়ার অযোগ্য— কলকাতার বাতাস নিয়ে এমন কথা এখন নতুন কিছু নয়। কিন্তু নতুন আশঙ্কার বিষয় হলো, দূষণের ক্ষেত্রে যেটা সব চেয়ে ক্ষতিকর, বাতাসে ভাসমান সেই অতি সূক্ষ্ম কণা বা পিএম (পার্টিকুলেট ম্যাটার)২.৫–এর মাত্রা কমাতে দেদার সরকারি টাকা খরচ করা হলেও তাকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না।
পিএম২.৫ সরাসরি শ্বাসযন্ত্রে ঢোকে বলে সেটা সব চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ) ‘ট্রেসিং দ্য হেজ়ি এয়ার ২০২৫— প্রগ্রেস রিপোর্ট অন ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’ (এনসিএপি বা এনক্যাপ) নামে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে বাতাসে পিএম২.৫-এর মাত্রার নিরিখে রাজধানী–শহরগুলোর মধ্যে কলকাতা দেশে ২ নম্বরে।
তবে রাজ্যের মধ্যে কলকাতার চেয়েও এই দূষণ কণার মাত্রা বেশি আসানসোল-দুর্গাপুরের মতো জেলা শহরে। রাজ্যের যে ৬টি শহরকে পিএম২.৫–এর এর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে হলদিয়ার অবস্থা মন্দের ভালো।
ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রামের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশের ১৩০টি শহরকে চিহ্নিত করেছে। কলকাতা ছাড়া রাজ্যের অন্য শহরগুলো হলো: হাওড়া, আসানসোল, দুর্গাপুর, ব্যারাকপুর এবং হলদিয়া। এর মধ্যে গত বছর এই ৬টি শহরের মধ্যে ৫টিতেই পিএম২.৫–এর গড় মাত্রা ছিল সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
হলদিয়া ছাড়া বাকি ৫টি শহরের ওই দূষণকণার মাত্রা বেশি ছিল জাতীয় গড় মাত্রার চেয়ে। হলদিয়ায় ২০২৪ সালে পিএম২.৫–এর গড় মাত্রা ছিল ৩৭। এই দূষণ কণার জাতীয় গড় মাত্রা ৪৭। কলকাতায় গত বছর পিএম-২.৫ কণার গড় মাত্রা ছিল ৬০। গত বছরে ১০৭ দিন মহানগরে ওই দুষণ কণার মাত্রা ছিল সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেকটাই বেশি। পিএম২.৫ কণার নিরিখে রাজ্যের মধ্যে সব থেকে দূষিত শহর এখন আসানসোল। গত বছর আসানসোলে পিএম২.৫–এর এর গড় মাত্রা ছিল ৭৩। তার পরেই রয়েছে দুর্গাপুর (৭২), তার পর হাওড়া (৬৫)। ব্যারাকপুরের পিএম২.৫–এর এর গড় মাত্রা ছিল ৫৯।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, পিএম২.৫–এর কারণে শ্বাসযন্ত্রের রোগের হার অনেক বেড়ে গিয়েছে। এবং বেড়েছে মৃত্যুর হারও। মহামারী বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণাতেও এটা প্রমাণিত। সে জন্যই বিশেষজ্ঞরা ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রামের (এনক্যাপ) আওতায় থাকা শহরগুলোয় পিএম২.৫–এর নিন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। জ্বালানি, বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি বা ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার বাড়ার ফলে তৈরি হওয়া দূষণ মোকাবিলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কার্যকর করার সুপারিশ করা হয়েছে। কঠোর নীতি তৈরির পাশাপাশি নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা আরোপ করা এবং তা বাস্তবায়নে কালক্ষেপ না–করার উপর জোর দিতে বলা হয়েছে সরকারকে।
সিআরইএ-র বিশেষজ্ঞ মনোজ কুমার বলছেন, ‘পিএম২.৫ নিয়ন্ত্রণে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার হওয়াটা জরুরি। গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে উন্নতিটা দেখা যায়।’ তাঁর বক্তব্য, ‘যে ১৩০টি শহরকে এনক্যাপ–এর তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, সেই তালিকা ২০২৪ সালে অপরিবর্তিত রয়েছে। কোনও শহরের বাতাসের মানের এমন উন্নতি হয়নি, যাতে সেটিকে তালিকার বাইরে নিয়ে আসা যায়। বরং শহরগুলোর বাতাসের মানের অবনতিই হয়েছে।’ তার পরামর্শ, ‘প্রতি দু’বছর অন্তর রিভিউ করা উচিত, আর কোনও শহরকে এই তালিকায় আনা প্রয়োজন কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে।’
২০১৯ থেকে ২০২৫— এই সময়সীমার জন্য এনক্যাপের আওতায় থাকা শহরগুলোয় পিএম২.৫ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১১ হাজার ২১১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খরচ হয়েছে ওই বরাদ্দের মাত্র ৬৮ শতাংশ অর্থ। ওই তহবিলের মাত্র এক শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে জনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই খাতে বরাদ্দের অঙ্ক অবিলম্বে বাড়ানো দরকার।