এই সময়: কলকাতা পুরসভার ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডে বাঁশদ্রোণী মিস্ত্রিপাড়ার ১৩৮ বন্দিপুর রোডে চারতলা আবাসন যে পুকুর বুজিয়ে বেআইনি ভাবে তৈরি হয়েছে, হাইকোর্টে তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল। অনেক গড়িমসির পর হাইকোর্টের নির্দেশে পুরসভা ওই বেআইনি নির্মাণ ভাঙার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল।
মঙ্গলবার দলবল নিয়ে গিয়েও পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের আধিকারিকরা কার্যত সে আবাসন না-ভেঙেই ফিরলেন। উল্টে পুর–বাহিনী ভেঙে দিল একচালা এক চালের দোকান। দোকানদার আশিস (টুকাই) চক্রবর্তী বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে সাত-আট বছর ধরে মামলা চালিয়েছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আশিসের উপরে পুরসভার এই কোপে বেআইনি নির্মাণচক্রের সঙ্গে পুরসভার একাংশের যোগসাজশের অভিযোগই উঠছে।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, আজ যেখানে চারতলা আবাসন, বছর পনেরো আগেও ছিল পুকুর। ধীরে ধীরে সেই পুকুর বোজানো শুরু হয়। ওই জলাশয়ের মালিকের সঙ্গে হাত মেলায় ডেভলপার। আশ্চর্যজনক ভাবে ২০১৩-য় বোজানো পুকুরের জমিতেই চারতলা আবাসনের প্ল্যান স্যাংশন করে পুরসভা।
ছোটবেলা থেকে দেখে আসা পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাট তৈরির চেষ্টার মতো বেআইনি কাজ মানতে পারেননি আশিস। পুরসভায় চিঠিচাপাটি করেও বিহিত না-হওয়ায় হাইকোর্টে মামলা করেন সহৃদয় কয়েক জন আইনজীবীর সাহায্যে। বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের সিঙ্গল বেঞ্চ ২০১৭-র এপ্রিলে জমির চরিত্র সম্পর্কে পুরসভাকে শুনানির নির্দেশ দেয়।
শুনানি ডেকেও স্থগিত করে দেয় পুরসভা। উল্টে সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে মামলা করে পুরসভাই। ডেভলপারের স্বার্থরক্ষায় পুরসভার এমন উদ্যোগে বিস্মিত হয়েছিল বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার ও বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চও। উপরন্তু ব্লক ভূমি আধিকারিকের রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়ে হাইকোর্ট নিশ্চিত হয়, বাঁশদ্রোণী মৌজার ৩৭৬ খতিয়ানে ২৩৭ নম্বর প্লটটি, যার আয়তন ২৪ শতক (প্রায় ১৫ কাঠা), সেটি পুকুর হিসেবেই নথিভুক্ত। পুর–আইনের ৩৯৭ ধারায় পুরসভাকেই ফের শুনানি ও পদক্ষেপের নির্দেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। কী করে পুকুর বোজানো জমিতে বিল্ডিং প্ল্যান স্যাংশন করল পুরসভা—সে প্রশ্নও তোলে হাইকোর্ট।
২০১৮–য় পুরকমিশনার মেনে নেন, ভুয়ো তথ্যে স্যাংশন প্ল্যান অনুমোদনে ভুল হয়েছে। পুর–আইনের ৪০০ (১) ধারায় বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ হয়। তার পরেও চলে টালবাহানা। কখনও ডেভলপার, কখনও ফ্ল্যাটের আবাসিকরা হাইকোর্টে পর পর মামলা করেছেন। সর্বত্রই হেরেছেন।
সর্বশেষ গত ১৫ জানুয়ারি বিচারপতি শম্পা দত্ত পাল তিন মাসের মধ্যে পুর–কমিশনারের ২০১৮–র নির্দেশ কার্যকারী করার রায় দেন। গত ১০ মার্চ ভাঙার বিজ্ঞপ্তি জারি করেন ১১ নম্বর বরোর বিল্ডিং বিভাগের এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। ২৫ মার্চ, মঙ্গলবার ভাঙার কাজে পুর–বাহিনী আসবে বলে আবাসনে নোটিসও দেওয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত পুর–বাহিনী এলেও বেআইনি আবাসনের নীচের গ্যারাজের দেওয়ালে হাতুড়ির ঘা মেরেই বিদায় নেয়। আবাসিকরা দরজা না–খুলে উপরের বারান্দা থেকে কাকুতি–মিনতি শুরু করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, পুরসভা প্ল্যান স্যাংশন করেছে দেখেই তাঁরা ফ্ল্যাট কিনেছিলেন।
পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না–করে মাথার উপর থেকে ছাদ কাড়া যাবে না। তীব্র উত্তেজনায় এক আবাসিক অসুস্থও হয়ে পড়েন। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেন স্থানীয়রাই। বিকেলে পুর–আধিকারিকরা এলাকা ছাড়েন ভাঙার কাজ বাকি রেখেই। বিল্ডিং বিভাগের এক আধিকারিক জানান, আদালতে ফের সময় চাওয়া হবে। আশিসও ফের আদালতের দৃষ্টি আকর্যণ করতে চলেছেন নির্দেশ অমান্যের অভিযোগে।