সোমনাথ মাইতি, তমলুক
রাজ্য ও জাতীয় হেরিটেজের স্বীকৃতি আগেই মিলেছিল। এ বার ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতি পেতে চলেছে তাম্রলিপ্ত রাজবড়ি। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বিভাগের পক্ষ থেকে গত ১১মার্চ একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে রাজবাড়ির বর্তমান সদস্য দীপেন্দ্রনারায়ণ রায়ের কাছে।
নিয়ম অনুসারে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক বিশ্ব ঐতিহ্য প্রকল্পে ২১টি দেশ নিয়ে গঠিত একটি কমিটি এই তালিকা তৈরির কাজ করে থাকে। একাধিক মানদণ্ডের ওপর বিবেচনার পরে কোনও সৌধ, প্রাসাদ, মিনার, অরণ্যেকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে যেমন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতি পেয়েছে সুন্দরবন।
এই তকমা পাওয়ার আগে বেশ কিছু মাপকাঠিতে পাশ হতে হয়েছে। তবেই বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেকের স্বীকৃতি মিলেছে। ঠিক সে ভাবেই তাম্প্রলিপ্ত রাজবাড়িকেও এই তকমা পেতে গেলে বেশ কিছু মাপকাঠির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
জানা গিয়েছে প্রথম পর্যায়ের মানদণ্ড পেরানোর পর পরবর্তী মানদন্ড যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি। রাজবাড়ির বর্তমান সদস্য দীপেন্দ্র নারায়ণ রায় বলেন,‘বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও তমলুক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের লক্ষ্যে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, মহাভারতের সময় থেকে প্রাচীন ভারতের পরিচিত জনপদ ছিল তাম্রলিপ্ত।
প্রাচীন ভারতীয় , চিনা ও গ্রিক পরিব্রজকদের লেখা গ্রন্থে প্রাচীন বানিজ্য নগরী তাম্রলিপ্তের উল্লেখ রয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্রাট অশোকের সময়ে প্রাচীন তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়েই ধৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা (সিংহল)–সহ নানা দেশে। সময়ের সঙ্গে তাম্রলিপ্ত বন্দর হারিয়ে গেলেও বিভিন্ন সময়ে পাওয়া কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন জিনিসপত্র বর্তমান তমলুকের প্রাচীনত্বের প্রমাণ দেয়। তৃতীয়-চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে অষ্টম খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তাম্রলিপ্ত দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। গ্রিক ভৌগলিক টলেমির লেখাতে তাম্রলিপ্তের উল্লেখ রয়েছে।
রাজবাড়ির ইতিহাস কেবল বাণিজ্য ঘিরে নয়, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অধ্যায়ের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এই তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ি। রাজবাড়ির সদস্যরাই জানিয়েছেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তমলুকের রাজবাড়িতে এসেছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ অন্য জায়গায় সুভাষচন্দ্রকে সভা করতে না দেওয়ায় রাজবাড়ির আম বাগান পরিষ্কার করে সভার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল।
সাংস্কৃতিক দিক থেকেও ও এই রাজবাড়ির বড় অবদান রয়েছে। দীপেন্দ্র নারায়ণ বলেন, ‘২০১৩ সালে ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা এসে রাজবাড়ি ঘুরে দেখে গিয়েছেন। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে তাম্রলিপ্ত ও বৌদ্ধ ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। গত বছর ডিসেম্বর মাসের ২৫,২৬,২৭ তিন দিনের এই সেমিনারে শ্রীলঙ্কা,মায়ানমার, বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়া, ভুটান, নেপাল, জাপান, অস্ট্রেলিয়া–সহ ১৪টি দেশের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি গবেষক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপকরা এসেছিলেন শুধু তাই নয় অনলাইনেও অনেক দেশের প্রতিনিধিরাও অংশ নিয়েছিলেন।’
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পাওয়ার জন্য একাধিক সদস্য দেশের সমর্থন লাগে। ইতিমধ্যেই নেপাল সমর্থন দিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তবে ইউনেস্কোর একটা অংশের এই বিষয়ে সমর্থন থাকলেও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণার জন্যে জন্যে সংশ্লীষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সুপারিশ লাগে। বিশেষ করে রাজ্য সরকারের।
কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই সুপারিশ করে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজবাড়ির সদস্য। এ বার রাজ্য সরকারের সুপারিশ পেলেই অনেকটা ধাপ এগিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।