• নারী-স্বনির্ভরতার অনন্য দৃষ্টান্ত মেদিনীপুরের সুলেখার সংগ্রাম
    এই সময় | ২৭ মার্চ ২০২৫
  • প্রীতিকণা জানা

    ‘মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।/ দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,/নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।’ সকলেই জীবনের কোনও না কোনও সময়ে রবীন্দ্রনাথের এই গানের কাছে আশ্রয় নেন। জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে যখন নিজেকে নিঃস্ব, রিক্ত মনে হয়, ঠিক তখনই এই গান মুক্ত করে অন্তরের সব ভয়। ফিরিয়ে দেয় হারানো আত্মবিশ্বাস।

    খেজুরি থানার বড়তল্যা গ্রামের সুলেখা দাস পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাঁকা চাউনি, কটূক্তি, লজ্জা, সঙ্কোচ এবং নিজের ভিতরের ভয়কে মুক্ত করে আত্মবিশ্বাসের জোরে সামলান টোটোর হ্যান্ডেল। লিঙ্গ ও শারীরিক সক্ষমতা যে কোনও পেশার একমাত্র ধ্রুবক নয়, তা প্রমাণ করেছেন তিনি।

    পথিককে নিরাপদে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাজ। তার জন্য রোজ তাঁকে যুদ্ধ করতে হয় ঘরে-বাইরে। জন্ম অভাবী ঘরে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সুলেখা সবার ছোট। অভাবের জ্বালায় বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেননি। সম্বল প্রাথমিক শিক্ষাটুকুই। বাবা ছিলেন দিনমজুর। সুলেখার তখন আঠারো বছর বয়স। বাবা ধার-দেনা করে বহু কষ্টে মেয়েকে পাত্রস্থ করেন।

    সব মেয়েই স্বপ্ন দেখেন, বিয়ের পরে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে ঘর করবেন। কিন্তু ওই, বিধি বাম! স্বামী-সুখ বেশিদিন কপালে সইল না। স্বামীর অত্যাচারে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চিরদিনের জন্য বাপের বাড়ি চলে আসতে হলো। বাপের বাড়িতে এসেও শান্তি নেই। দাদা-বৌদিরা তাঁর দায়িত্ব নিতে চাননি। পড়শিদের অনেকেই অনেক কথা বলতেন। সুলেখাকে নিয়ে বাপের বাড়িতে এমন ঝামেলা হয়েছে যে, কয়েকদিন না-খেয়েও থাকতে হয়েছে।

    পারিবারিক অশান্তির জেরে সুলেখা চাননি দাদা-বৌদির সংসারে বোঝা হয়ে বাঁচতে। বাবা-মাকে বুঝিয়ে, আলিপুর বাজারে পানের দোকান দিলেন। কখনও গ্রামের মেলায় চলে যেতেন। কিন্তু সে ভাবে আয় হতো না। কিছুদিন পরে গ্রামের কয়েকজন মহিলার সঙ্গে কাজের সন্ধানে কেরালায় চলে যান। সেখানে এলাচ তোলার কাজে যোগ দেন।

    শুরু হলো আর একটি নতুন যুদ্ধ। প্রতিদিন সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে এক ঘণ্টা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পৌঁছোতেন কাজের জায়গায়। আট ঘণ্টা ধরে এলাচ তুলতে হতো। এই ধকল বেশিদিন সহ্য হলো না। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ফের ফিরতে হলো বাবার বাড়ি। বাবার পরামর্শে ২০১৮ সালে তিনি টোটো কিনলেন।

    সেই সময়ে এই পেশা একচেটিয়া পুরুষদের দখলে। কেউ কখনও কোনও মেয়েকে টোটো চালাতে দেখেননি। সুলেখার মনে সর্বক্ষণ জমাট বেঁধে থাকত লজ্জা, ভয়ের মেঘ। মেয়ে হয়ে কী করে টোটো চালাবেন! তবে বাবা-মা সর্বদা সাহস জুগিয়েছেন। পেট তো আর অভাব বোঝে না! তাই লোক-লজ্জা সরিয়ে রেখে তিনি বেরিয়ে পড়লেন টোটো নিয়ে। সঙ্গে একরাশ স্বপ্ন। সৎ পথে রোজগার করে স্বনির্ভর হবেন। নিজেই হবেন নিজের হর্তা-কর্তা-বিধাতা।

    কিন্তু কে জানত এখানেও শরের মতো ওত পেতে আছে সমাজের বিদ্রুপ। যে মেয়ের ঘরের পর্দার আড়ালে থেকে রান্নাবান্না, বাচ্চাকাচ্চা সামলানোর কথা, সেই মেয়ে টোটো নিয়ে রাস্তায় ঘুরবে! অতএব, ছিটকে আসতে শুরু করল কুকথা। সুলেখার অভিজ্ঞতা— পুরুষদের চেয়ে মহিলারা বেশি কটূক্তি করতেন! তাঁদের অনেকেই বলতেন, ‘ছি, ছি! ম্যায়ালোক কি টোটো চালায় আড়িয়ার মতো!’ (ছি ছি, মেয়ে কি ছেলের মতো টোটো চালায়!)। কেউ আবার বলতেন, ‘দূর দূর ওর গাড়িয়ে উঠবোনি। ওর কি গাড়িয়ে লাইসেন্স আছে? ম্যায়ালোকের গাড়িয়ে কিসের তরে উঠব?’ (দূর দূর ওর গাড়িতে উঠব না। ওর গাড়ির কি কোনও লাইসেন্স আছে। মেয়ে লোকের গাড়িতে কিসের জন্য উঠব?)।

    বাড়ি ফিরে চোখের জলে বালিশ ভেজাতেন। বাবা-মা ফের বোঝালেন, লোকের কথায় মনখারাপ করে বসে থাকলে কেউ খেতে দেবে না। সুলেখা মন শক্ত করে ফের পথে নামলেন। আলিপুরে তেমন যাত্রী পাওয়া যেত না। তাই তিনি রসুলপুর ঘাটে যান। ওখানে সবাই পুরুষ টোটো চালক। প্রথমে সবাই হাঁ করে দেখতেন। সুলেখার সব কথা শুনে দু’-একজন রাজি হলেন। বেঁকেও বসলেন কয়েকজন। তাঁরা বললেন, ‘অ্যায় ম্যায়ালোক টোটো চালিতে চলিয়াসছে। কাল কাকে ধাক্কা মারি দিবে। তুই তার দায়িত্ব লিবি?’ (মেয়েমানুষ টোটো চালাতে চলে এসেছে, যদি কাউকে ধাক্কা মেরে দেয় তুই কি তার দায়িত্ব নিবি?)

    টোটো চালকদের মধ্যেই শুরু হলো দ্বন্দ্ব। মাস ছয়েক সেখানে টোটো চালাতে পারেননি সুলেখা। কিন্তু তিনিও হাল ছাড়ার মেয়ে নন। একদিন আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রসুলপুর ঘাটে রুখে দাঁড়ালেন এক প্রবীণ, ‘হউ ম্যায়ালোক গাড়ি লিয়াসছে, ত কী হচে? সে তো খাটবে খাবে।’ (হোক মেয়েমানুষ, গাড়ি নিয়ে এসেছে তো কী হয়েছে? সে তো নিজে খেটেই খাবে)।

    তারপরে টোটোচালকরা স্ট্যান্ডে গাড়ি চালাবার সম্মতি দেন। সম্মতি তো মিলল, তারপরে? সুলেখার কথায়, ‘পথম পথম সব লোক উঠতে চাইতো নি। কইত মেয়েছেলের গাড়িতে উঠবোনি।’ (প্রথম প্রথম সব লোক টোটোয় উঠতে চাইত না। তারা বলত, মহিলার গাড়িতে উঠব না।)। তবে পরিস্থিতি বদলেছে। লোকজন সুলেখার এই যুদ্ধকে সম্মান করেন। এখন তাঁদের অনেকেই বলেন, ‘মা গো, তোর গাড়িয়ে উঠবো বলিয়া বাড়ছি থাইলি।’ (মা গো, তোর গাড়িতে উঠব বলেই এতদিন অপেক্ষা করেছিলাম) সুলেখা মূলত দিনেই টোটো চালান। তবে রাতে পাড়ার কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে মুশকিল আসান করেন তিনিই। পড়শিদের বিপদে-আপদে এখন সুলেখাই ভরসা।

    এখন আর কেউ কটূ কথা বলেন না। মাথা উঁচু করে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচেন সুলেখা। এখন তিনি স্বনির্ভর। বাবা-মায়ের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এই সুলেখাই এখন খেজুরির অনেক মেয়ের আইকন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেঁধে দেওয়া ছকের বাইরে পা বাড়িয়ে, অনেক যুদ্ধ করে তিনি ছিনিয়ে নিয়েছেন জয়। তিনি যেন সেই বাতিওয়ালা যিনি আলো হাতে খেজুরির অন্তঃপুরের মেয়েদের সুপ্ত স্বপ্নকে আলো দেখাচ্ছেন। আর মুক্ত কণ্ঠে বলছেন— ‘...শিকল ছিঁড়ে একবার দাঁড়াও তুমি/উঠে দাঁড়াও নারী/মেরুদণ্ড সোজা করে একবার দাঁড়াও/তুমি হাঁটো। এই পথ তোমার...।’

    (লেখক গবেষক ও সমাজকর্মী। মতামত ব্যক্তিগত)

  • Link to this news (এই সময়)