সুমন ঘোষ, পিংলা
বিকল্প চাষে প্রতি মাসে গড় আয় এক লক্ষ টাকা! নাহ্, ছাপার ভুল নয়। বছরে তা হলে কত দাঁড়াচ্ছে? সরল পাটিগণিতে বারো লক্ষ টাকা! যে দেশে ফসলের দাম না-পেয়ে কৃষক মৃত্যুর কথা হামেশাই শোনা যায়, যে দেশে একই কারণে প্রতিবাদ হিসেবে পথে আনাজ ফেলে দিয়ে বিক্ষোভ দেখান চাষিরা, সেখানে এই বিষয়টি শুনে কি অবাক লাগছে? আসুন, আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই সুব্রত মহেশের। সুব্রত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলার গোগ্রামের বাসিন্দা। এক একর জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করেই তিনি এখন অন্যদেরও পথ দেখাচ্ছেন।
সুব্রতর ফলানো ড্রাগন ফ্রুট কেবল রাজ্যের বাজারেই নয়, পাড়ি দিচ্ছে কুয়েত, বাহারিনও। ফল এবং চারা বিক্রি করে বছরে আয় করছেন প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ টাকা। লাভ-ক্ষতির অঙ্ক শোনাতে শোনাতে হাসিমুখে সুব্রত বলছিলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা কী জানেন? এই ড্রাগন ফ্রুট আম, জাম, কাঁঠাল গাছের মতোই বহু বছর বাঁচে। ফলে চাষের এলাকা বাড়ালে অন্য ব্যাপার। না হলে শুধু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করলে বছরের পর বছর ধরে শুধুই লাভ আর লাভ।’
সুব্রত প্রথমে চারটি খুঁটিতে ড্রাগন চাষ করেন। তারপর ধীরে ধীরে জমির পরিধি বাড়ান। প্রথমে মরক্কন রেড এবং সুইট ভিয়েতনাম হোয়াইট ভ্যারাইটি দিয়ে চাষের শুরু। এখন এক একর জমিতে রয়েছে ৫৫০টি খুঁটি। এখন ইজ়রায়েল লেমন, ইয়েলো, পার্পেল, রেড ভেলভেট, জাম্বু রেড, ভিয়েতনাম হাইব্রিড, সিয়াম রেডের মতো হরেক কিসিমের ড্রাগন ফল চাষ করছেন। তাদের স্বাদও ভিন্ন ভিন্ন।
সুব্রতর কথায়, ‘ড্রাগন ফ্রুট রপ্তানির বড় সূযোগ রয়েছে। যেহেতু আমার ফার্মে বেশি চাষ হয় না, তাই বিভিন্ন আনাজ ও ফলের সঙ্গে জায়গা পেলে আমার ড্রাগন ফ্রুট বিদেশে যায়। কিন্তু বেশি মানুষ চাষ করলে একটি বড় কন্টেনারে শুধু ড্রাগন ফ্রুটই বিদেশে পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। ফলে এই চাষ বাড়ানোরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে রাজ্যে। আমিও ধীরে ধীরে চাষ বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’
নতুন চাষ শুরু করতে খরচ কেমন?
সুব্রত জানান, নিজের জমি থাকলে চাষের উপযোগী করে ভরাট করার জন্য খরচ হয়। তারপরে রয়েছে চারা কেনা আর খুঁটি তৈরি করা। যার উপরে গাছগুলো থাকে। সব মিলিয়ে প্রথমে একর প্রতি আনুমানিক খরচ ৭ লক্ষ টাকা। প্রথম বছরে ফলের আশা না-করাই ভালো। তবে দ্বিতীয় বছর থেকে ধীরে ধীরে ফলন মিলবে। পঞ্চম বছরে গিয়ে দেখা যাবে, এই চাষের জন্য যত টাকা খরচ করা হয়েছিল, সমস্ত খরচ উঠে গিয়েছে, সঙ্গে সামান্য লাভ। ষষ্ঠ বছর থেকে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাদ দিয়ে ফল এবং চারা বিক্রি করে খুব কম করে হলেও বছরে ১২ লক্ষ থেকে সাড়ে ১২ লক্ষ টাকা আয় হবে।
সুব্রতর সংযোজন, ‘ড্রাগন গাছে মে-জুন থেকে ফুল আসে। ফুল আসা শেষ হয় নভেম্বরে। অর্থাৎ টানা ৬ মাস ধরে ফলন মেলে। ফুল আসার ৪৫ দিনের মধ্যেই ফলন। প্রতি খুঁটিতে ন্যূনতম ২৫-৩০ কেজি ফল মেলে অনায়াসে। কেজি প্রতি গড়ে ১২৫ টাকায় বিক্রি করা যায়।’
তবে সুব্রতর এই সাফল্য কিন্তু সহজে আসেনি?
ধান, আলু, আনাজ, ফুল চাষ ছেড়ে নাম-না জানা ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরির চাষ করবে ছেলে? এ সব করতে গিয়ে যে সামান্য জমিটুকু রয়েছে সেটাও দেনার দায়ে বিক্রি করতে হবে না তো? তা হলে সংসার চলবে কী ভাবে? সুব্রতর প্রস্তাব শুনে প্রথমে তাঁর বাবার থেকে ছিটকে এসেছিল একের পর এক প্রশ্নবাণ! সে প্রায় চোদ্দো বছর আগের কথা। তখন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কৃষক কেন, বহু মানুষ স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুটের নামই শোনেননি। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পাশ সুব্রত নাছোড়। শেষ পর্যন্ত বাবার উপরে অভিমান করেই বেরিয়ে পড়েন সটান নদিয়ার উদ্দেশে। তারপরে?