সুমন ঘোষ, পিংলা
বাবার উপরে অভিমান করে বেরিয়ে পড়লেন সুব্রত মহেশ। বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট। গলার কাছে নোনতা দলা। এ দিকে, এতদিনের বোনা স্বপ্নটাও তাঁকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না।
অতএব, চালাও পানসি রানাঘাট। রানাঘাট কেন? পিংলার গোগ্রামের সুব্রত বলছেন, ‘প্রথমে তো স্ট্রবেরি দিয়েই বিকল্প চাষ শুরু করেছিলাম। কারণ, ড্রাগন ফ্রুটের চেয়ে স্ট্রবেরি চাষের খরচ কম। দ্রুত আয়ও করা যায়। আর এই স্ট্রবেরি চাষে আমার হাতেখড়ি হয়েছিল প্রয়াত হরিদাস মণ্ডলের কাছে।’
সেই সময়ে হরিদাস ছিলেন রানাঘাটের কৃষি আধিকারিক। তিনি তখন স্ট্রবেরি চাষে দিশা দেখাচ্ছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার ছাপা হচ্ছে বিভিন্ন কাগজে। দূরদর্শনেও অনুষ্ঠান করেছেন। সেখান থেকেই হরিদাসকে চিনেছিলেন সুব্রত। তারপরে তাঁর ফোন নম্বর জোগাড় করে সটান পাড়ি দেন নদিয়ার রানাঘাটে।
সুব্রতর জেদ ও নাছোড় মনোভাব দেখে খুশি হন হরিদাসও। নিজের বাড়ির ছাদে তিনি কী ভাবে স্ট্রবেরি চাষ করছেন তা শিখিয়ে দেন সুব্রতকে। চারা দিয়েও সাহায্য করেন। সেই চারা নিয়ে সুব্রত বাড়ি ফেরেন। পরিবারের সাড়ে তিন বিঘে জমির মধ্যে মাত্র আড়াই কাঠা জমি চেয়ে নেন তিনি। ছেলের জেদের কাছে হার মেনে এক রকম বাধ্য হয়েই স্ট্রবেরি চাষ করতে দেন বাবাও।
এ বার আরও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হলো সুব্রতকে। আড়াই কাঠা জমিতে স্ট্রবেরি ও চারটি ড্রাগন ফ্রুট লাগিয়েছিলেন প্রথমে। ধীরে ধীরে স্ট্রবেরি ফলতে থাকে। কিন্তু তখনও গ্রামের মানুষ বা এলাকার পাখিদের সেই স্বাদ অজানা। সুব্রত বলেন, ‘আর সেই কারণে প্রথমে বেশি পাহারা দিতে হয়নি। মানুষ বা পাখি যদি স্ট্রবেরির স্বাদ জানত, তা হলে আর রক্ষে ছিল না!’
ফল তো মিলল। এ বার বিক্রি করবেন কোথায়? কাছাকাছি বাজার বলতে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে মেদিনীপুর শহর। স্ট্রবেরি ব্যাগবন্দি করে দোকানে দোকানে ঘুরতে শুরু করলেন সুব্রত। দোকানদাররা নিতেন। কিন্তু শর্ত একটাই, বিক্রি হলে তবেই টাকা দেবেন। এ ভাবে চলতে চলতে হোঁচট খেতে হচ্ছিল। ফের হরিদাসের শরণ নেন সুব্রত। হরিদাসই তাঁকে হাওড়া বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
একদিন পাঁচ হাজার টাকার স্ট্রবেরি বিক্রি করে বাড়ি ফিরলেন সুব্রত। সেই টাকা বাবার হাতে তুলে দিতেই বাবা তো আকাশ থেকে পড়লেন। ধান চাষ করে যেখানে দু’বেলা খেয়ে বছরে পাঁচ হাজার টাকা রোজগার হয়, সেখানে এইটুকু জমিতে একদিনেও এত টাকা রোজগার করা যায়! এ বার বাবাও সরাসরি ছেলের পথেই হাঁটলেন। চেনা ফুল ও ধান চাষ ছেড়ে বাড়তে থাকল স্ট্রবেরি চাষের জমি। আড়াই কাঠা থেকে ৫ কাঠা, ১০ কাঠা, এখন একেবারে এক একর! বছর শেষে দেখা গেল, আয় হয়েছে প্রায় ছ’লক্ষ টাকা।স্ট্রবেরি চাষের আয় থেকে কিনলেন আরও প্রায় তিন একর জমি। সেই জমিতে বাড়তে থাকল ড্রাগন ফ্রুটের চাষও। এ ক্ষেত্রেও প্রথমে বাজার ধরতে বেশ সময় লেগেছিল। একবার তো হাওড়া বাজারে ড্রাগন ফ্রুট বিক্রি করতে যাওয়ার সময়ে হাওড়া স্টেশনে বেশ বিপদে পড়তে হয়েছিল সুব্রতকে। সে কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে তাঁর।
ব্যাগ তল্লাশি করতে গিয়ে আরপিএফের এক জওয়ান চমকে উঠেছিলেন। তিনি ড্রাগন ফ্রুটকে বোমা ভেবেছিলেন। সুব্রত বলছেন, ‘আমি হিন্দি জানি না। কোনও রকমে আরপিএফকে বোঝাই, এটি বোমা নয়, ড্রাগন ফ্রুট। কিন্তু তিনিও গোঁ ধরে বসে থাকলেন। শেষে একজন পদস্থ আধিকারিক এলেন। তিনি দেখার পরে বুঝতে পারেন, বোমা নয়, সত্যিই ড্রাগন ফ্রুট। তারপরে আমার মুক্তি মেলে!’