সুমন ঘোষ, খড়্গপুর
সামুদ্রিক মাছের মধ্যে অ্যান্টি–ডায়াবিটিক গুণ! মাছ খেলেই বাড়ছে ইনসুলিন নিঃসরণ! তা হলে কি ডায়াবিটিস প্রতিরোধে আর মুঠো মুঠো ওষুধ খাওয়ার দরকার হবে না? প্রয়োজন পড়বে না ইনসুলিন নেওয়ারও? কারণ, ভোলা ভেটকির মতো সামুদ্রিক মাছ খেলে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে থাকবে ডায়াবিটিস, দাবি কয়েকজন গবেষকের।
পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত বেলদা কলেজ। তার নিউট্রিশন বিভাগের অধ্যাপক কৌশিক দাস, সঞ্জয় দাস এবং রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রাবন্তী পাইন, দেবলীনা গিরি-সহ কয়েকজন মিলে তিনটি স্তরে গবেষণা করে এই সাফল্য পেয়েছেন। কৌশিক বলছেন, ‘তিন ধরনের সামুদ্রিক মাছে অ্যান্টি–ডায়াবিটিক উপকরণ পেয়েছি। ইঁদুরের উপরে গবেষণাও হয়েছে।’
এ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ নিউট্রিশনাল সায়েন্সেস-সহ আরও দু’টি জার্নালে তাঁদের পেপার প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র–লাগোয়া রামনগর ব্লকের ১২৪ জন এমন পুরুষ-মহিলাকে তাঁরা প্রথমে চিহ্নিত করেন যাঁরা নিয়মিত সামুদ্রিক মাছ খান। উল্টো দিকে, বাঁকুড়ার কোতুলপুরের ১২৪ জন পুরুষ–মহিলাকে চিহ্নিত করা হয়, যাঁরা সামুদ্রিক মাছ খান না। শুধু মিষ্টি জলের মাছ খান। গবেষণায় দেখা যায়, যাঁরা সামুদ্রিক মাছ খান তাঁদের ডায়াবিটিসের প্রবণতা নেই। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে রয়েছে।
সামুদ্রিক মাছে কী এমন গুণ রয়েছে, যে ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে রাখছে? আর মিষ্টি জলের মাছেই বা কী রয়েছে?
গবেষকেরা সামুদ্রিক মাছ হিসেবে ভোলা ভেটকি, রুলি, তাপড়া আর মিষ্টি জলের বাটা, ফলুই এবং মৌরলা মাছ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গবেষকদের দাবি, দেখা গিয়েছে, মিষ্টি জলের ছোট মাছেও প্রচুর পরিমাণ তেল রয়েছে, যা ডায়াবিটিস বাড়িয়ে দেয়। সামুদ্রিক মাছে কম পরিমাণে তেল থাকলেও ভোলা ভেটকি, রুলি এবং তাপড়ার তেলে মিলেছে অ্যান্টি–ডায়াবিটিক গুণ।
বিশেষত, ভোলা ভেটকির মধ্যে যে ডোকোসাহেক্সেনয়িক অ্যাসিড এবং কিছু যৌগিক ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, তা ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। এর পরে গবেষকরা ইঁদুরের উপরে পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু করেন। কিছু ইঁদুরকে ইঞ্জেকশন দিয়ে সুগারের পরিমাণ বাড়ানো হয়। সাধারণ ইঁদুরের ক্ষেত্রে যেখানে সুগারের পরিমাণ ৭১.৪ এমজি/ডিএল, সেখানে ইঞ্জেকশন দেওয়া ইঁদুরের সুগার বাড়িয়ে করা হয় ৪১১.২ এমজি/ডিএল। আর সাধারণ ইঁদুরের ইনসুলিনের পরিমাণ যেখানে ২.৩ ন্যানোগ্রাম/এমএল, সেখানে ডায়াবিটিক ইঁদুরের ইনসুলিনের পরিমাণ ১ ন্যানোগ্রাম/এমএল করা হয়।
এ বার ডায়াবিটিক ইঁদুরকে টানা ২৮ দিন খালি পেটে ৬০ মিলিগ্রামের মতো ভোলা ভেটকির তেল ও মাছ খাওয়ানো হয়। তারপর রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যায়, ইনসুলিনের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ২.৫ ন্যানোগ্রাম/এমএল এবং সুগারের পরিমাণ কমে হয়েছে ৯৭.২ এমজি/ডিএল।
কৌশিক বলেন, ‘শুধু এটাই নয়, ডাইপেপটিডাইল পেপটিডেস-৪ নামক যে এনজ়াইমটি প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নিঃসরণে বাধা দেয়, তাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম এই মাছের মধ্যে থাকা ডিএইচএ। ফলে শরীর থেকে সাধারণ নিয়মে ইনসুলিন নিঃসরণ হয় এবং ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।’
এ বার প্রয়োজন অন্য রূপে মানুষের উপরে প্রয়োগ। সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ শুরু করেছেন গবেষকেরা। কৌশিক জানিয়েছেন, সবার আগে প্রয়োজন এই মাছকে পাউডার বা অন্য কোনও খাবারের আদলে নিয়ে আসা। কারণ, অনেকে ভোলা ভেটকি খেতে পছন্দ নাও করতে পারেন। আবার সব জায়গায় এই মাছ নাও মিলতে পারে। তাঁদের জন্যই ক্যাপসুল বা অন্য খাদ্যের আদলে আনা প্রয়োজন। তাঁর কথায়, ‘গবেষণার মধ্য দিয়ে মানুষের ওপর প্রয়োগ করতে গেলে আইসিএমআরের অনুমতি প্রয়োজন। আমরা ধীরে ধীরে নিয়ম মেনে প্রতিটি পদক্ষেপই করব।’
এ প্রসঙ্গে ডায়াবিটোলজিস্ট দেবাশিস বসু বলেন, ‘ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে মাছের ভূমিকা নিয়ে বহু দিন আগেই কাজ হয়েছে। নতুন করে আরও কাজ হচ্ছে, এ তো খুবই ভালো কথা। ডায়াবিটিস তো আসলে একটা ইনফ্ল্যামেশন। ভোলা ভেটকি সত্যিই খুব স্বাস্থ্যকর একটা মাছ। ওর ভিতরে যে যে পুষ্টিগুণ রয়েছে, তা শরীর পক্ষে উপকারী।’