সুমনা চক্রবর্তী
কারবালার মাঠে রিকশাটা দাঁড় করিয়ে রিকশাকাকু গিয়েছে নাজ়নিনকে ডাকতে। একেক দিন আমিও রিকশা থেকে নেমে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাই ওদের বাড়ি। চাচি, মানে নাজ়ের মায়ের সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগে বেশ। চাচি কত কত বই পড়ে। আর কী শৌখিন মানুষ।
আমি আর নাজ় এক রিকশায় স্কুলে যাই। শিবমন্দির আর মীরচক পাশাপাশি পাড়া। মীরচকে কারবালার মাঠে এক প্রান্তে প্রাসাদের মতো বাড়ি নাজ়দের। রোজ আমাকে প্রথমে বাড়ি থেকে তুলে নাজ়ের বাড়ি আসে রিকশাকাকু। ওদের বাড়ির দেওয়ালটা যেখানে শেষ হচ্ছে, তার গা ঘেঁষেই পরপর অনেকগুলি ঝুপড়ি। সেখানে চট বিছিয়ে বসে কাঁথা বা আসন সেলাই করে হাসি দিদি, রুবিনা চাচিরা। আমার সঙ্গে টুকটাক গল্প করে। দাদু-মামের (ঠাকুমা) খোঁজ নেয়। আমাদের পরিবার আগে ওই পাড়ায় ভাড়া থাকত কি না! দাদুর বাতের ব্যথাটা বেড়েছে শুনে কী এক আসমানি তেল শিশিতে ভরে বাড়ি বয়ে এসে দিয়ে যায় সিমির মা।
সে দিন রিকশায় বসে বসে দেখছি, সব্বার হাতে মগের মতো একটা জিনিস, তার মাথায় একটা হাতল। সেটা ঘোরালেই মগের নীচ দিয়ে মোটা মোটা চাউমিন বের হচ্ছে। ‘তোমরা সবাই চাউমিন তৈরি করছ হাসি দিদি?’
আমার গবেট প্রশ্ন শুনে মুখে ওড়না চাপা দিয়ে সে কী হাসি হাসি দিদির! সিমি আর হারানও হেসে কুটিপাটি। হালিমা চাচিকে যদিও আমার একটুও ভালো লাগে না। কেমন যেন ক্যাটক্যাট করে কথা বলে। সে দিনও রেগে রেগেই বলল, ‘চিমিন কেন হবে রে ছুঁড়ি? ইস্কুলে পড়িস, সেমুই চিনিস না?’ চিমিন শুনে ফিক করে হেসে ফেলি। হালিমা চাচি মুখ বেঁকিয়ে বলে, ‘মেয়ের ঢং দেখে বাঁচি না বাপু!’
গা-পিত্তি জ্বলে যায় আমার! এরই মধ্যে হঠাৎ সাইকেলে ক্রিং ক্রিং! তাকিয়ে দেখি, সেই বিশ্রি লোকটা। ক’দিন ধরেই বিরক্ত করছে স্কুলে যাতায়াতের পথে। আমার দিকে তাকিয়ে কেমন বাজে ভাবে হাসে যেন! গা ঘিনঘিন করে আমার। আজ হঠাৎ লোকটা এসে আমার হাত ধরে টান দেয়। সঙ্গে সেই বিশ্রী হাসিটা।
আমার ভয়ে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে ফেলেছি। হঠাৎ লোকটা হাত ছেড়ে দিল। সঙ্গে জোর চিৎকার, ‘ওরে বাবা রে! মেরে ফেললে রে!’ চোখ খুলে দেখি, লোকটার মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। পিছনে বাঁশ হাতে দাঁড়িয়ে হালিমা চাচি। পাশে ঝাঁটা হাতে সিমির মা, হাসি দিদিরা। লোকটা টলমল করতে করতে পালায়। হইচই শুনে ততক্ষণে ছুটে এসেছে চাচি আর নাজ়ও। সে দিন আর স্কুল যাওয়া হলো না। সবাই আমাকে বাড়ি রেখে এল।
এর পর উইক-এন্ড, তারপরে আবার ইদের ছুটি। ক’দিন এমনিতেও স্কুল বন্ধ। বাড়িতে সবার মুখ থমথমে। বাবা-মায়ের আলোচনা, আমি নাকি বড় হয়ে গিয়েছি। আমার একান্নবর্তী পরিবারে বিশ্লেষণ চলছে, আমার চালচলনেরই কোনও সমস্যা আছে কি না। বারবার মনে হচ্ছে লোকটার বিশ্রী হাসিটাই জিতে গেল।
ক’দিন পরে হালিমা চাচি এসে হাজির। হাতে একটা বড় বাটি। আমার কাছে এসে বলে, ‘নে ছুঁড়ি, সেমুইয়ের পায়েস আনছি তোর জন্য। মন খারাপ করতে নেই। আজ যে খুশির ইদ!’ মাথায় একটা হাত পড়ায় চোখ বন্ধ করে ফেলি। জল গড়ায়। আর ঠিক তখনই হালিমা চাচি, খড়খড় করে করে বলে ওঠে, ‘অ্যাই মেয়ে, কথায় কথায় চোখ বন্ধ করবি না। হারামজাদাদের চোখের দিকে সোজা তাকাবি। তার পর তেড়ে প্রতিবাদ করবি। দ্যাখ না, কার কত দম?’
সেই অশিক্ষিত, চাউমিনকে চিমিন বলা হালিমা চাচি এখন আমার টিচার। রোজ স্কুল যাওয়ার পথে আমিও প্রতিবাদের ভাষা শিখি এখন। ঠিক করেছি, ভয় পেয়ে আর চোখ বন্ধ করব না কখনও!