সুনন্দ ঘোষ
ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে ছারখার হয়ে যাওয়া মিয়ানমারে হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু সংবাদের নীচে চাপা পড়েছিল আরও একটি খবর।
শুক্রবার থরথর করে কাঁপতে থাকা ইয়াঙ্গনের মাটিতে মিশে গিয়েছিল সেখানকার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) টাওয়ার। সেই মুহূর্তে টাওয়ারে চাকরি করছিলেন যে চার অফিসার, সেই লে অং, থ কো কো, হানি রান এবং নাইং মো–এর আত্মার প্রতি শান্তি জানাতে রবিবার কলকাতার এটিসি অফিসারেরা কয়েক মিনিট নীরবতা পালন করলেন। শেষ তিনজনই মহিলা অফিসার। তবে খবর শুধু সেটা নয়।
খবর — টাওয়ার হুড়মুড়িয়ে মাটিতে মিশে যাওয়ায় ইয়াঙ্গনের এটিসি থেকে ওভারফ্লাইং বিমানের নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হচ্ছে। আর সেই সমস্যার প্রভাব পড়ছে ভারতের উপরেও। কলকাতার প্রাক্তন এটিসি কর্তা ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রাক্তন ইডি কল্যাণ চৌধুরী জানাচ্ছেন, অসংখ্য আন্তর্জাতিক উড়ান এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়ে যাওয়ার সময়ে ভারতের আকাশ ব্যবহার করে। তার মধ্যে কলকাতার এটিসি একটি বড় সংখ্যক উড়ান নিয়ন্ত্রণ করে। এরা মূলত রাতের দিকে আকাশের অনেক উপর দিয়ে উড়ে যায়। এই সব উড়ান পূর্ব থেকে কলকাতার আকাশে ঢোকে মিয়ানমার হয়ে। ভারতের গায়ে বাংলাদেশ থাকলেও, মাত্র ১০ শতাংশ আন্তর্জাতিক উড়ান সেই দেশের এটিসি–র নিয়ন্ত্রণে থাকে। একই ভাবে পশ্চিম থেকে উড়ে আসা বিমান কলকাতা ছাড়িয়ে চলে যায় মিয়ানমারের আকাশে। কল্যাণের কথায়, ‘যত সংখ্যক ওভারফ্লাইং ইন্টারন্যশনাল ফ্লাইট কলকাতার এটিসি হ্যান্ডল করে, তত সংখ্যকই হ্যান্ডল করতে হয় মিয়ানমারকে।’
তা হলে উপায়?
কলকাতা বিমানবন্দর সূত্রের খবর, যেহেতু ইয়াঙ্গনের এটিসি টাওয়ার ভেঙে পড়েছে, তাই সেখানকার আকাশে, একই রুটে, একই উচ্চতায় এবং একই অভিমুখে দু’টি বিমানের সামনে–পিছনে ব্যবধান বা সেপারেশন এখন ১৫ মিনিট করে রাখা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে নজরদারির অভাব হলেও দু’টি বিমান কাছাকাছি চলে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ভারত–সহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এই সেপারেশন ১০ মিনিট থাকে। তাতে কমবেশি ১৫০ কিলোমিটার দূরত্ব থাকে দু’টি বিমানের মধ্যে। কলকাতা এটিসি–র এক কর্তার কথায়, ‘মিয়ানমার থেকে আমাদের আকাশে বিমান ঢোকার সময়ে এখন সেপারেশন থাকছে ১৫ মিনিট। আমাদের আকাশে বিমান ঢোকার পরে ধীরে ধীরে সেই ব্যবধান আমরা কমিয়ে আনছি। আবার পশ্চিম থেকে যে আন্তর্জাতিক উড়ানগুলি কলকাতায় আসছে, কিছু আগে থেকেই তাদের সেপারেশন বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাতে, মিয়ানমারে ঢোকার সময়ে দু’টি বিমান নিজেদের মধ্যে সেপারেশন ১৫ মিনিট রাখতে পারে। যতদিন না ইয়াঙ্গনের পরিস্থিতি ঠিক হচ্ছে, এ ভাবেই এখন চলবে।’ এ কথা নোটাম (নোটিস টু এয়ারমেন) জারি করে বিশ্বকে জানিয়েও দিয়েছে ইয়াঙ্গন এটিসি।
এতে ক্ষতি কী হবে?
কল্যাণ চৌধুরীর কথায়, ‘ধরে নিন, একই উচ্চতায় ১০ মিনিটের ব্যবধানে ঘণ্টায় ছ’টি বিমানকে রাখা যাচ্ছিল। এ বার সে ক্ষেত্রে চারটি বিমানকে রাখা যাবে। এর ফলে, বাকি দু’টি বিমানকে অন্য উচ্চতায় পাঠাতে হবে বা তাদের রুট বদল করতে হবে। এতে এটিসি–র কাজের চাপ তো বাড়বেই। পাশাপাশি অন্য রুট দিয়ে গেলে সেই বিমানের জ্বালানি বেশি পুড়তে পারে। গন্তব্যে পৌঁছতে বেশি সময় লাগতে পারে।’
তবে, একটি সূত্রের দাবি, এমনটা ভাবা ঠিক নয় যে মিয়ানমারের আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া কোনও বিমানের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারছে না ইয়াঙ্গন এটিসি। টাওয়ার ভেঙে পড়লেও তাদের এরিয়া কন্ট্রোল বিল্ডিংটি অন্য জায়গায় ছিল। সেটি অক্ষত রয়েছে। সেখান থেকে যতটা সম্ভব বিমানের উপরে গতিবিধি রাখা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিতে চাইছে না মিয়ানমার সরকার। তাই, দু’টি বিমানের মধ্যে সেপারেশন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
হঠাৎ এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে কি কোনও প্রস্তুতি থাকে না?
কল্যাণ বলছেন, থাকে। প্রথমেই কিছু রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছু রুটের কিছু উচ্চতায় ফ্লাইট উঠতে দেওয়া হয় না। মোদ্দা কথা, এটিসি–র কোনও কমিউনিকেশন ছাড়াই যাতে বিমান নির্বিঘ্নে উড়ে যেতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হয়। তবে, সেটি একটি ছোট এয়ার স্পেস বা এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাই বাঞ্ছনীয়। এটিসি–র সঙ্গে কমিউনিকেশন ছাড়া অনেকটা আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়াটা ভীষণই ঝুঁকির — জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব জুড়ে প্রতিটি এটিসি–র ক্ষেত্রেই এই কনটিনজেন্সি প্ল্যান থাকা বাধ্যতামূলক।
কলকাতা থেকে মিয়ানমারের আকাশে থাকা বিমান কন্ট্রোল করা যায় না?
কল্যাণ জানিয়েছেন, অনেকদিন আগে বঙ্গোপসাগরে তাদের সিটটেয়ে ও কোকো আইল্যান্ডে মিয়ানমার সরকার দু’টি এডিস–বি (অটোমেটিক ডিপেন্ডেন্ট সারভিলেন্স–ব্রডকাস্ট) বসিয়েছে। রেডারের মতো এর সাহায্যেও বিমানের গতিবিধি ফুটে ওঠে এটিসি টাওয়ারের মনিটরে। সেই দুই এডিএস–বি–এর সাহায্যে দক্ষিণ মিয়ানমারের গোটা আকাশের ফ্লাইট মুভমেন্ট এখন কলকাতার এটিসি টাওয়ারে বসে দেখা যায়। এ ছাড়া ইম্ফলে বসানো রেডারের সাহায্যে মিয়ানমারের উত্তর আকাশের অনেকটা অংশ দেখতে পান কলকাতার এটিসি অফিসারেরা।
কিন্তু, দেখলেই তো হবে না। এক দেশের অনুমতি ছাড়া তাদের আকাশের বিমান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না অন্য দেশ। মিয়ানমারের পূর্বে রয়েছে থাইল্যান্ড। সেখানকার ব্যাঙ্কক এটিসি টাওয়ারের আওতা থেকে একই ভাবে আন্তর্জাতিক উড়ান মিয়ানমারে ঢোকে। মাঝে মিয়ানমারের আকাশ পুরোপুরি এটিসি–র নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, তখন ব্যাঙ্কক এটিসি–র সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে হবে কলকাতাকে। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।