প্রদীপ চক্রবর্তী, সিঙ্গুর
২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর সিঙ্গুর থেকে ন্যানো কারখানা সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রতন টাটা। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গ়ড়িয়েছে। সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো কারখানা গড়ার জন্য জোর করে অনিচ্ছুক চাষিদের জমি অধিগ্রহণের সরকারি সিদ্ধান্তকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে ইতিমধ্যেই সেই জমি ফেরতও পেয়ে গিয়েছেন চাষিরা। সিঙ্গুর এখন পুরোদস্তুর ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’। কিন্তু সিঙ্গুর বিতর্ককে আবারও নতুন করে উস্কে দিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লন্ডন সফর।
কয়েক দিন আগে লন্ডনের অক্সফোর্ডের একটি কলেজে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ চলাকালীন প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ দেখান কিছু মানুষ। তারই মধ্যে এক বিক্ষোভকারী সিঙ্গুর থেকে টাটাদের পাততাড়ি গোটানোর জন্য সরাসরি তৃণমূল নেত্রীকে দায়ী করেন। সেই ভিডিও ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। যাকে হাতিয়ার করছে বিরোধীরা। এই ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই কাঠগড়ায় তুলছেন অনেক সিপিএম নেতা। বিজেপি নেতারাও একযোগে মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করছেন। যদিও সিঙ্গুর ইস্যুতে মমতার পাশেই রয়েছেন সেখানকার কৃষকরা। তাঁদের অনেকেই মনে করছেন, সিঙ্গুর ব্যর্থতার দায় তৎকালীন বাম সরকারের। তৎকালীন সিপিএম সরকারের ভুল জমি অধিগ্রহণ নীতির জন্যই টাটারা সিঙ্গুর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের রায়েও তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে।
তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক বর্তমানের বিজেপি নেতা রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা, ‘রাজ্যপালের সঙ্গে সিঙ্গুরের জমি নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল সেটা না মেনে সিঙ্গুরের ক্ষতি করেছেন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন।’ তিনি জানান, সিঙ্গুর থেকে টাটারা চলে যাওয়ার ফলে শুধু সিঙ্গুরের নয় গোটা রাজ্যের শিল্পায়ন থমকে গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা সমঝোতা চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, ইচ্ছুক চাষিদের জমিতে কারখানা হোক। এই মর্মে প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর সামনে একটা সমঝোতা হয়েছিল। সেই চুক্তি বাতিল হওয়ায় তা আর কার্যকর হয়নি।’
এক সময়ে সিপিএমের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সিঙ্গুরের খাসেরভেড়ির বাসিন্দা অকুলচন্দ্র দাস। কিন্তু সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের নামে সিপিএমের অত্যাচার ও খুন–জখমের বিরোধিতা করে দল ছাড়েন। তিনি বলেন, ‘সে সময় পার্টির মাতব্বররা দলের একাংশকে ভুল বুঝিয়ে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। সিপিএম যদি কৃষকদের দাবি সহানুভূতির সঙ্গে দেখত, তাহলে সিঙ্গুরের ইতিহাসটা অন্য ভাবে লেখা হতো।’
সিপিএমের হয়ে এক সময় পঞ্চায়েত ভোটে লড়ে ছিলেন তারা কোলে। তিনি বলেন, ‘সিপিএমের ভুলে শিল্প ও কৃষি দুটোই নষ্ট হয়েছে। গায়ের জোরে জমি দখল না করে সরকার যদি তখন আলোচনায় বসতো তাহলে সিঙ্গুরের সর্বনাশ হতো না।
২০১৬ সালে ২০ অক্টোবর দেশের শীর্ষ আদালতের রায়ে নিজেদের চাষের জমি ফিরে পেয়েছেন সিঙ্গুরের কৃষকেরা। সেই রায়ের পর সিঙ্গুরের গোপালনগর মৌজায় এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী কৃষকদের হাতে প্রতীকী ভাবে জমি তুলে দিয়েছিলেন। জমিতে সরষে ছড়িয়ে কৃষকদের হাতে বীজও তুলে দিয়েছিলেন।
সরকারের তরফে সে সময় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ন্যানো কারখানার জমিকে আবার চাষের যোগ্য করে তোলা হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে সরকার। পরবর্তীকালে কিছু জমিতে ধান, আলু ও আনাজ চাষ হলেও অনেক জমিতেই এখন চাষবাস হচ্ছে না। চাষের জমি ভরে গিয়েছে আগাছায়। অন্তত এমনটাই অভিযোগ করছেন সিঙ্গুরের কৃষকরা। তা নিয়ে ক্ষোভ জন্মাচ্ছে চাষিদের মধ্যে। সিঙ্গুর বন্ধ্যা জমি পুর্নব্যবহার কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক দুধকুমার ধাড়া ও মহাদেব দাস বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসন ও নেতাদের একাংশ মুখ্যমন্ত্রীকে সিঙ্গুরের জমির ভবিষ্যত নিয়ে ভুল বুঝিয়েছেন। আমরা চাই মুখ্যমন্ত্রী সরজমিনে এসে দেখে যান। আমরা সব সময় মুখ্যমন্ত্রীর পাশে থাকব।’
শ্রীরামপুর সাংগঠনিক জেলার তৃণমূলের সভাপতি অরিন্দম গুঁই বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী বিদেশে বাংলার সন্মান বৃদ্ধি করছেন। কিছু আগাছা যাঁদের মানুষ প্রত্যাখান করেছে তাঁরা অসভ্যতা করবে, এটা স্বাভাবিক। মানুষ তাঁদের জবাব দেবে।’