অর্ঘ্য ঘোষ, ময়ূরেশ্বর
মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করতেই প্রতিবেশী এবং আত্মীয়রা গায়ে পড়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘ঢের হয়েছে, এ বার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও। সেই তো শ্বশুরবাড়ির হেঁশেল ঠেলবে। বেশি পড়াশোনা করে কী হবে? স্বজাতির মধ্যে পাত্র পাওয়া যাবে না।’ তাতে কর্ণপাত করেননি বাবা–মা। সে দিনের ষোড়শী শর্মিলা দাসের চোখে ছিল স্বপ্ন, জীবনে কিছু করে দেখানোর তাগিদ।
বাবা–মায়ের সাধ ছিল, সাধ্য ছিল না। বাবা পরমেশ্বর দাস পেশায় ঢাকি। মা রেণুকা লোকের বাড়ি পরিচারিকার কাজ করতেন। টানাটানির সংসার। টিউশন পড়িয়ে নিজেদের খরচ চালাতেন তিন ভাইবোন। শিক্ষকতা করার ইচ্ছে ছিল শর্মিলার। কিন্তু টাকার অভাবে প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি। তাতে দমেননি শর্মিলা। নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। গ্র্যাজুয়েশনের পরে ২০১৯ সালে সিউড়ি পুলিশ লাইনে লেডি কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেন। বছর ২৯–এর শর্মিলা এখন বাবা–মায়ের সহায় শুধু নন, গোটা পাড়ার এবং সেই সঙ্গে নিজের স্কুলের রোলমডেল।
বীরভূমের ময়ূরেশ্বর থানার কুলিয়াড়া বায়েনপাড়ায় বাড়ি শর্মিলাদের। তিরিশটি পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রামের বাসিন্দাদের অধিকাংশই হয় ঢাকি, নয়তো দিনমজুর। শর্মিলার অনমনীয় জেদ আজ অন্যরকম ভাবতে শিখিয়েছে তাঁদের। ঘরের মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহিত করছেন তাঁরা। আসলে নিজের পাড়ার প্রথম গ্র্যাজুয়েট শর্মিলা। একমাত্র মহিলা সরকারি কর্মীও। শর্মিলা বলেন, ‘আমাকে পড়ানোর সামর্থ্য বাবা–মায়ের ছিল না। কিন্তু আমার পড়াশোনার আগ্রহ দেখে অনেকেই সাহায্য করেছেন। বইপত্র, টাকা, পোশাক দিয়ে অনেকেই পাশে থেকেছেন। নিজেও টিউশন পড়িয়েছি। সকাল–বিকেল নিয়মিত শরীরচর্চার অভ্যেস ছিল। তাই টাকার অভাবে যখন টিচার হওয়া হলো না, তখন পুলিশের চাকরিতে যাওয়ার কথা ভাবি।’
শর্মিলা কঠিন সময়ে পাশে পেয়েছিলেন দাদা সম্পদ এবং ভাই সুবীরকে। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের চেয়েও শর্মিলার লড়াই বেশি ছিল ও মেয়ে বলে। সারাক্ষণ আত্মীয়–প্রতিবেশীরা বিয়ের কথা বলত। ও কান দেয়নি সে সবে। এখানে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়ার চল রয়েছে। কিন্তু ওর আগ্রহ দেখে বাবা–মা কখনও জোর করেনি।’
স্থানীয় কুলিয়াড়া হেমশশী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ দাস বলেন, ‘শর্মিলা খুব কষ্ট করে বড় হয়েছে। সে দিনগুলিতে ওকে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে দেখেছি। আজ, ওকে দেখিয়ে স্কুলের ছেলেমেয়েদের অনুপ্রাণিত করি। অভিভাবকরাও ওঁকে দেখে মেয়েদের পড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছেন।’
প্রতিবেশী চরণ দাস, সুনীল দাসরা বলেন, ‘আগে ভাবতাম, আমাদের মতো ‘দিন আনি দিন খাই’ পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাটা গরিবের ঘোড়ারোগের সমান। আর মেয়ে হলেই তার বিয়ে নিয়ে চিন্তা হতো। শর্মিলা সেই ভুল ভেঙে দিয়েছে। আমাদের ঘরের মেয়েদেরও এখন স্কুলে পাঠাচ্ছি। বুঝতে পেরেছি, বিয়ে নয়, ওদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো দরকার।’
তিন ভাইবোনই বলেন, ‘বাবা–মা খুব কষ্ট করে আমাদের বড় করেছেন। ওঁদের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলাম। সেটুকু করে দেখিয়েছি আমরা।’ বাবা–মায়ের কথায়, ‘আমরা চেয়েছিলাম, ওরা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। ছেলেদের কাজের কথা সবাই বলত। আমরা চেয়েছিলাম, মেয়েও যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের সব স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।’
শর্মিলা বলেন, ‘আমি চাই, সব মেয়েই যেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়।’