সুমন ঘোষ, খড়্গপুর
আটপৌরে ফালি একটা মাঠ। মুসলিমরা বলেন, ‘জানাজার মাঠ’। আর হিন্দুদের কাছে ‘পুজোর মাঠ’। একপাশে রয়েছে মুসলিমদের শব রাখার স্থায়ী বেদি। যেখানে শব রেখে জানাজার প্রার্থনা করেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। আবার ইদের নমাজও পড়েন।
অন্যদিকে রয়েছে পুজোর জন্য ছোট্ট বেদি। যেখানে দুর্গা, কালী, সরস্বতী পুজো হয়। কী, অবাক লাগছে? তা হলে, আপনি সটান চলে আসুন মেদিনীপুর শহরের সিপাইবাজার এলাকার দেবছায়া কলোনির মাঠে। বহু বছর ধরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উৎসব পালন করে চলেছেন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, তুষার মাইতি, হামিদ খান, মিরাজুল ইসলামরা।
দেবছায়া নবারুণ সঙ্ঘ পুজো কমিটির সভাপতি ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘যে বছর দুর্গাপুজোর সময়ে ইদ পড়ে সে বার মাঠের মাঝ দিয়ে কাপড় টাঙিয়ে দেওয়া হয়। একদিকে ওঁরা নমাজ পড়েন। অন্যদিকে, আমরা পুজো করি।’ কিন্তু পুজোর সময়ে হঠাৎ কারও মৃত্যু হলে? তখন তো জানাজার প্রার্থনার জন্য দেহ এই মাঠেই নিয়ে আসা হয়। ফাল্গুনী বলেন, ‘আমরা সেই সময়ে পুজোর মাইক বন্ধ রাখি। ওদের প্রার্থনা শেষ হলে আবার আমাদের পুজো, অনুষ্ঠান শুরু হয়।’
সিপাইবাজার-বড় আস্তানা মুসলিম সমাজ উন্নয়ন কমিটির সম্পাদক হামিদ খানের কথায়, ‘কার কখন মৃত্যু হবে তা তো বলা যায় না। একবার দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিনে আমাদের এলাকার একজনের মৃত্যু হলো। তখন অষ্টমীর অঞ্জলি চলছে। জানাজার মাঠে গেলাম। আমরা পৌঁছতেই ওঁরা মাইক বন্ধ করে দিলেন। আমরা প্রার্থনা করলাম। ওঁরা মাইক বন্ধ রেখেই অঞ্জলি দিলেন।’
সংগঠনের সভাপতি শেখ মিরাজুল ইসলামের পণ, ‘এই ফালি মাঠটাই সম্প্রীতির নজির হয়ে থাকবে। আমরা আজীবন এই সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখব।’ দেবছায়া কলোনি পুজো কমিটির সদস্য তুষারকান্তি মাইতি, শুভেন্দু কর জানালেন, সেই ১৯৭৭ সাল থেকে এই মাঠে পুজো হচ্ছে। কোনওদিন কোনও সমস্যা হয়নি। সব বছর পুজোর সময়ে ইদ পড়ে, এমন নয়। মাঝে মধ্যেই তেমনটা ঘটে। সে সময়ে দু’পক্ষের লোকজনই দু’পক্ষকে আগলে রেখে উৎসব পালন করেন।
শেখ আনোয়ার, শেখ সারাফত জানান, এই মাঠে এক সঙ্গে দেড় হাজার মানুষ নমাজ পড়তে পারেন। সিপাইবাজার ও সংলগ্ন এলাকার বহু মানুষ এখানে নমাজ পড়েন। নমাজ শেষে আনন্দ ও কোলাকুলিতে মেতে ওঠেন সকলে। সেই সময়ে বহু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও মাঠে আসেন। নমাজ শেষে গল্পগুজব করেন।
অন্যদিকে, পুজোর সময়ে মুসলিমরাও পুজো দেখার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে আসেন। হামিদ বলেন, ‘প্রাণ থাকতে আমরা এই সম্প্রীতি নষ্ট হতে দেব না।’ ষাটোর্ধ্ব ফাল্গুনী হামিদ-মিরাজুলদের সঙ্গে গল্প করতে করতে শবদেহ রাখার বেদির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বলছিলেন, ‘একসঙ্গে চলতে চলতে আমাদের এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে যে, আর কাউকে আজানের সময় মনে করাতে হয় না। কেউ না কেউ গিয়ে ঠিক পুজোর মাইকটা বন্ধ করে দেয়। যে যার ধর্ম নিজের মতো পালন করি। আর উৎসব তো সবার! তাই না?’