• দুর্নীতি ধরিয়ে দিয়েছিলেন, চাকরিও হারালেন সেই ওঁরা
    এই সময় | ০৪ এপ্রিল ২০২৫
  • এই সময়: জামার রং নীল। ঘামে ভিজে সেই জামার রং যেন কালো হয়ে গিয়েছে। চোখের কোনায় জমা জল। তাঁর চাকরিটা আর নেই। তিনি, চন্দননগরের সৈকত ঘোষ রোজ সাড়ে তিন ঘণ্টা যাতায়াত করে বাড়ি থেকে স্কুল, স্কুল থেকে বাড়ি পৌঁছতেন। হুগলির চন্দননগর থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর যে অনেকটা দূর!

    ২০১৬ সালে এসএসসি–র পরীক্ষা দেওয়ার পর নিয়োগের দাবিতে একের পর এক মিছিলে হেঁটেছেন সৈকত। কখনও পুলিশের ধাক্কা খেয়েছেন, কখনও জলকামানের জলের ধাক্কায় লুটিয়ে পড়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালে নিয়োগপত্র হাতে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সৈকতদের মতো অনেকের আন্দোলনের কারণেই প্রথম বেআব্রু হয় এসএসসি–র নিয়োগ দুর্নীতি। কিন্তু দশচক্রে যেমন ভগবানও ভূত হন, তেমনই সৈকতদের সেই আন্দোলনই যেন তাঁদের আবার সেই রাস্তাতেই এনে দাঁড় করাল। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রাক্তন শিক্ষক হয়ে গেলেন তাঁরা।

    ফুঁপিয়ে উঠে সৈকত বলেন, ‘যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এত লড়াই করলাম, সেই লড়াইয়ের জন্য কি আমাদের চাকরিটাও গেল?’ বাড়িতে তিন বছরের মেয়ে, স্ত্রী, মা–বাবা। মেয়েকে এ বছরই স্কুলে ভর্তি করানোর চিন্তা–ভাবনা চলছিল। কিন্তু এখন সবই যেন এক অনিশ্চয়তার অন্ধকারে।

    তেমনই আফসোস ঝরে পড়ছে শর্মিষ্ঠা বারের কথায়। তিনিও একটা সময়ে রাস্তায় নেমে চাকরির দাবিতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। এ দিন তিনিও চাকরিহারা। চাকরি হারিয়ে শহিদ মিনারের সামনে বিরক্তিকর গরম আর চড়া রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে কখনও কাঁদতে কাঁদতে, কখনও আর্তনাদ করে শর্মিষ্ঠা বলছিলেন, ‘জাজেদের বাড়ি থেকেও টাকা উদ্ধার হচ্ছে। এই সিস্টেমে কে দুর্নীতি করেনি? আমরা সাধারণ মানুষ। দুর্নীতি করার সাহস নেই বলেই কি আমাদের খেসারত দিতে হলো?’

    গত কয়েক মাস ধরে লাগাতার ধর্না চালাচ্ছেন ওঁরা। এতদিন ধর্না চলছিল, আদালত যাতে ‘যোগ্য’–দের নিয়োগ বহাল রাখে, সেই দাবিতে। কিন্তু শীর্ষ আদালত যোগ্য–অযোগ্যদের মধ্যে কোনও ফারাক করতে পারেনি। বৃহস্পতিবারও সকাল থেকেই ধর্মতলায় শহিদ মিনার চত্বরে কেউ গাছের তলায়, কেউ আবার মাটিতেই কাপড় বিছিয়ে বসে পড়েন। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ। উত্তেজনায় বুক ঢিপ ঢিপ। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই রায় ঘোষণা করল সুপ্রিম কোর্ট।

    কলমের এক খোঁচায় চাকরিহারা ওঁরা সবাই। কেউ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন, কেউ ডুকরে উঠলেন। টিভি–তে খবর দেখার পর কাউকে কাউকে বাড়ি থেকে অহরহ ফোন। কেউ ফোন ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছেন। কেউ কেউ আবার ফোন ধরলেন না। সদ্য চাকরিহারা ইল্লাজুর রহমান বলছিলেন, ‘ফোন করে মা জানতে চাইছে, সুপ্রিম কোর্টে কী হলো? মা–কে কী বলব, বলুন?’ ওঁদের অনেকেই সখেদে ব‍লছেন, ‘আর ধর্না দিয়ে কী হবে? সব তো শেষ!’ বৃহস্পতিবার দুপুর গড়াতেই কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল শহিদ মিনারের ধর্নামঞ্চ।

  • Link to this news (এই সময়)