• উধাও দালালরা, ফেরত দিতে হবে বেতন, অযোগ্য ছেলের জন্য হাহাকার ভ্যানচালকের
    এই সময় | ০৪ এপ্রিল ২০২৫
  • সমীর মণ্ডল, মেদিনীপুর

    তাঁর ফোন বন্ধ। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। তাঁর তো আমও গিয়েছে, ছালাও গিয়েছে।

    ১২ থেকে ১৪ লক্ষ টাকা দিয়ে যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন বলে সিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছিল, তার মধ্যে রয়েছে এই যুবকের নাম। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরের বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার খবর এসেছে, চাকরি আর নেই। ঘরে খিল এঁটেছেন তিনি। যে টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন, সে ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। উপরি — এতদিন চাকরি করে যে টাকা রোজগার করেছিলেন সেটাও ফেরত দিতে হবে। তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা।

    আর তাঁর বাবা এখন ভ্যান চালান। তিল তিল করে জমানো টাকাতে ১২ লক্ষ টাকার কিয়দংশও হওয়ার কথা ছিল না। হয়ওনি। তাই, হাত পাততে হয়েছিল। কিছু টাকা চড়া সুদেও নিয়েছিলেন। আর জমি–জায়গা যা ছিল তা বিক্রি করে দেন। সম্প্রতি চাকরি বাতিলের আশঙ্কা চেপে বসে। এই সে দিন প্রতিবেশীদের কাছে দুঃখ করে বলছিলেন, ‘ছেলের চাকরিটা চলে গেলে আর খেতে পাব না। ছেলের চাকরির জন্য জমি, জায়গা যা ছিল সব কিছু বিক্রিবাটা করে শেষ করে দিয়েছি। সংসার চালাতে একমাত্র ভরসা ছেলের চাকরিটাই। সেটাও যদি চলে যায়, সুইসাইড করা ছাড়া উপায় নেই!’

    আর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফোনে ধরা হলে বলেন, ‘জানি না কী করব! এখন টাকা ফেরত দিতে হলে আমাদের মরে যাওয়া ছাড়া কোনও রাস্তা নেই।’

    ২০১৬–য় স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)–র বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে চাকরির আবেদন করেছিলেন বহু যুবক–যুবতী। তাঁরা পরীক্ষায় বসে, ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। পরে এই নিয়োগ নিয়ে মামলা দায়ের হয়। অভিযোগ ওঠে, যোগ্যদের অনেককে বঞ্চিত করে ঘুরপথে অযোগ্যদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তে নামে সিবিআই। জানা যায়, স্রেফ টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন অনেকে। নির্দেশ মতো ‘লোক–দেখানো’ পরীক্ষায় ফাঁকা ওএমআর শিট বা উত্তরপত্র জমা দিয়ে এসেছেন তাঁরা। যে দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আজও জেলবন্দি।

    প্রথমে হাইকোর্ট আর এখন সুপ্রিম কোর্ট সে বার নিয়োগ হওয়া ২৫ হাজার ৭৫২ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরই চাকরি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এখনও অযোগ্য বলে চিহ্নিত প্রায় ৬ হাজার ২৭৬ জনকে এতদিন ধরে পাওয়া বেতন ফেরত দেওয়ার নির্দেশও এসেছে। কেশপুরের এই যুবকের নামও সেই তালিকায় রয়েছে। অন্য অনেক অযোগ্য নিজেদের অন্তরালে রেখেছেন। কোথাও ঘূণাক্ষরে বলছেন না যে টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু, কেশপুরের ভ্যানচালক সাধারণ সাদাসিধে মানুষ। গোপন করেননি টাকার বিনিময়ে তাঁর ছেলের চাকরি পাওয়ার কথা।

    জানিয়েছেন, একজনের মাধ্যমে পরিচয় হয় এক দালালের সঙ্গে। তাঁর মাধ্যমেই নাকি টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন তাঁর ছেলে। স্থানীয়দের কথায়, এলাকার একজন কলকাতার বিকাশ ভবনে চাকরি করতেন। তাঁর সূত্রেই যোগাযোগ। ওই যুবক নাকি একা নন। ওই এলাকার আরও কয়েকজনও নাকি টাকার বিনিময়ে স্কুল শিক্ষকের চাকরি পেয়েছেন। যাঁর মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয়েছিল, সিবিআইয়ের তদন্ত শুরু হতেই তিনি এলাকা ছেড়ে পালান। সূত্রের খবর, একটি পাড়াতেই এমন তিনজন শিক্ষক রয়েছেন। একজন ইতিহাসের, একজন জীবন বিজ্ঞানের এবং আরেক জন গণিতের শিক্ষক।

    প্রতিবেশীদের দাবি, চাকরি পাওয়ার পরে এঁদের কাউকে গর্ব করে জনসমক্ষেই বলতে শোনা গিয়েছে, ‘আসল লাইন ধরতে হবে। চাকরি হবে না মানে!’ কেউ তো নিজে চাকরি পাওয়ার পরে অন্যান্যদেরও প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন।

  • Link to this news (এই সময়)