এই সময়: 'আজ থেকে ইস্কুল ছুটি। আর পাঠশালা নাই।' হীরক রাজার শিক্ষামন্ত্রীর নিদানে উদয়ন পণ্ডিতের পাঠাশালা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দেশের শীর্ষ আদালতের রায়ে বাংলার বহু স্কুলের অনেকটা সেই দশা। বন্ধ না হলেও বহু স্কুলে কোনও বিষয়ে পড়ার শিক্ষকই থাকছেন না।
আশঙ্কার চোরা স্রোত ছিল। বৃহস্পতিবার সকালে দেশের শীর্ষ আদালতের রায় সামনে আসতেই রাজ্যের স্কুলগুলিতে কার্যত শ্মশানের চেহারা নেয়। স্টাফরুমে শোকের পরিবেশ, প্রধান শিক্ষককে জড়িয়ে ধরে কান্না, কারও নির্বাক বসে থাকা। পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রায় প্রতিটি স্কুলেই চার থেকে পাঁচ জন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, গ্রুপ ডি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি হারিয়েছেন। বর্ধমানের কৃষ্ণপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৌমেন কোনার জানান, তাঁদের স্কুলে চার জন শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে।
এ ছাড়াও গ্রুপ ডি কর্মীরাও রয়েছেন। প্রধান শিক্ষক বলেন, 'জোর গলায় বলতে পারি, আমার স্কুলে যাঁরা শিক্ষকতা করেছেন, তাঁরা যোগ্যতার সঙ্গেই শিক্ষকতা করেছেন। বিগত বছরগুলোয় স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা শুধু নয়, আমরাও উপকৃত হয়েছি। ওঁরা এক একটি দিক ধরেছিলেন। এখন তো আমাদের বলার কোনও মূল্য নেই। ওঁদের দিকে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে। এক জন শিক্ষক হয়ে কতটা যন্ত্রণায় রয়েছি সেটা বলে বোঝাতে পারব না।'
অনেকটা একই সুরে রথতলা মনোহর দাস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বলছেন, 'আমার স্কুলের চার জনের চাকরি গিয়েছে। কী ভাবে স্কুল চালাব জানি না। কঠিন সময়ের মধ্যে পড়লাম। এত দিন একসঙ্গে কাজ করেছি, আজ তাঁদের আমরা কী ভাবে ভুলে যাব?' চাকরিহারাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তিনি বলেন, 'আমার স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ঈর্ষা করার মতো। তাঁরা কী ভাবে অযোগ্য হয়ে গেল?' এ দিন চাকরিহারাদের পাশে থাকতে স্কুলে চলে আসেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক–শিক্ষিকারাও।' তেমনই এক জন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তুষার কর বলেন, 'আমার স্কুলে চার জনের চাকরি গিয়েছে। অথচ এরা সকলেই কলেজ সার্ভিস কমিশনে বসার যোগ্যতা অর্জনকারী ছেলেমেয়ে। নেট, সেট পাশ করেছে এরা। সিএসি পরীক্ষা হয়নি তাই তারা বসার সুযোগ পায়নি। আজ কী হবে। আমাকে জড়িয়ে ধরে ওরা কাঁদছিল। পাশে আছি এটাও তো জোর দিয়ে বলতে পারলাম না।'
ইউনিট টেস্ট হবে কী করে?
বহু স্কুলেই সামনে ইউনিট টেস্ট। চাকরি খারিজের রায়ে বিপাকে পড়েছেন ওই সব স্কুলগুলির প্রধান শিক্ষকরা। কালনার হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৭০০। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা ফাল্গুনি মল্লিক বলেন, 'আমাদের স্কুলে ছ'জনের চাকরি গিয়েছে। সাত এপ্রিল থেকে ইউনিট টেস্ট। কী করব কূল কিনারা পাচ্ছি না। অভাবনীয় ক্ষতি হলো।' কালনা মহারাজা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও চাকরি খুইয়েছেন ছয় জন। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রঘুনাথ মণ্ডলের মন্তব্য, 'আমাদের ১৮০০ ছাত্রের জন্য ৩৬ জন পার্মানেন্ট শিক্ষক। চাকরি হারানো ছয় জনের মধ্যে বায়োলজির দু'জন রয়েছেন। এখন পড়াশোনা কী ভাবে স্বাভাবিক রাখা যাবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম।'
শিক্ষক নেই, পড়াবেন কে?
দুর্গাপুরেও একাধিক স্কুলে চাকরি হারিয়েছেন বহু শিক্ষক। এই সংখ্যা সব থেকে বেশি দুর্গাপুরের নেপালিপাড়া হিন্দি হাই স্কুলে। এখানে চাকরি হারিয়েছেন আট জন। ডিপিএল গার্লস স্কুলে পাঁচ, বেনাচিতি হাই স্কুল, জেমুয়া ভাদুবালা স্কুলে চার, ভিড়িঙ্গি টিএন স্কুল, দুর্গাপুর রায়রানি হাই স্কুল, ডিপিএল বয়েজ, উখড়া কেবি ইনস্টিটিউটে চাকরি হারিয়েছেন তিন জন। এ ছাড়া বিধাননগর বয়েজ স্কুলে দু'জন ও এবিবি হাই স্কুল, সগড়ভাঙা হাই স্কুলে এক জন করে চাকরি হারিয়েছেন।
নেপালিপাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক কলিমূল হক বলেন, 'আমার স্কুলে চার হাজারের বেশি পড়ুয়া। শিক্ষক ৩৩ জন। সেখানে যদি আট জনের চাকরিই চলে যায়, তা হলে ২৫ জন টিচার নিয়ে কী ভাবে স্কুল চালাব বুঝতে পারছি না।' একই অবস্থা জেমুয়া ভাদুবালা বিদ্যালয়ের। প্রধান শিক্ষক জইনূল হকের বক্তব্য, 'আমার স্কুলে ১৮ জন টিচারের মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন চার জন। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১৪টি বিভাগ রয়েছে। সেখানে ১৪ জন টিচার নিয়ে কী ভাবে চলব জানি না। রাজ্যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারে শেষ করার চক্রান্ত বলে মনে হচ্ছে।' নেপালিপাড়া হাই স্কুলের চাকরি হারানো শিক্ষিকা প্রতিমা গিরি বলেন, 'সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করছি না কিন্তু, আমাদের মতো যোগ্যদের ভুলটা কোথায়? এটা আমাদের বলা হোক। আমরা তো পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে চাকরি পেয়েছি। যারা অযোগ্য তাদের জন্য যোগ্যদের চাকরি চলে গেল! এটা মেনে নিতে পারছি না।'
কেমিস্ট্রির টিচারই রইল না
আসানসোলেও শিক্ষক–সঙ্কটের কথা জানাচ্ছেন প্রধান শিক্ষকরা। ঢাকেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ে তিন জন শিক্ষক ও দু'জন শিক্ষাকর্মীর চাকরি গিয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এখন এক জনই মাত্র অঙ্কের শিক্ষক। এই অবস্থায় স্কুলের পঠন–পাঠন কী ভাবে চলবে বুঝে উঠতে পারেছেন না তিনি। আসানসোলের মহিলা কল্যাণ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, 'আমার স্কুলে ভূগোল ও ফিলোজ়ফির দুই শিক্ষিকার চাকরি গিয়েছে। এখন স্কুল চালানো সমস্যার হবে।' আসানসোলের উপেন্দ্রনাথ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক সোমনাথ গুপ্তর মন্তব্য, 'যাঁদের চাকরি গিয়েছে তাঁরা খুবই যোগ্য। এঁদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।' স্কুলের টিচার ইন–চার্জ পূর্ণচন্দ্র ঘোষের বক্তব্য, 'যিনি কেমিস্ট্রি পড়াতেন, তাঁর চাকরি গিয়েছে। এখন স্কুলে ওই বিষয়ে পড়ানোর আর কেউ রইলেন না।'
কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের ক্লাস কে নেবেন?
বরাবরই মাধ্যমিকে ভালো ফল করে বাঁকুড়ার স্কুলগুলো। সেই স্কুলগুলিতে এখন হাহাকার। বহু স্কুলেই বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ানোর কোনও শিক্ষক রইলেন না বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষকরা। বাঁকুড়া মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাধনচন্দ্র ঘোষ বলেন, 'বিজ্ঞান বিভাগের দু'জন শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। তাঁরা উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াতেন। এখন স্কুলে পঠন–পাঠনের সমস্যা হবে। সায়েন্সের ক্লাস চলবে কী করে? ক্ষতি তো হবে ছাত্রছাত্রীদের।'
একই সমস্যার কথা জানাচ্ছেন বাঁকুড়া গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সুমনা ঘোষ। তিনি বলছেন, 'চার জনের চাকরি গিয়েছে তাঁরা কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন, বায়ো সায়েন্স, জিয়োগ্রাফি, ফিজিক্সের শিক্ষিকা। এই চার জন চলে গেলে কী ভাবে চলবে? বিশেষ করে সমস্যা হবে একাদশ-দ্বাদশের কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে। ওই বিষয়ে উনিই ছিলেন একমাত্র শিক্ষিকা। ওই টিচার চলে গেলে যারা ক্লাস টুয়েলভ পরীক্ষা দেবে, তাদের কে পড়াবে?'
পুরুলিয়াতেও একাধিক স্কুল রয়েছে যেখানে বিশেষ কোনও বিষয়ে এক জন শিক্ষকও রইলেন না। কাশীপুর জেকেএম গার্লস হাই স্কুলের তিন শিক্ষিকা ও এক শিক্ষাকর্মী চাকরি হারিয়েছেন। যার জেরে এই স্কুলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রসায়ন, এই দুই বিষয়ের শিক্ষিকার পদ খালি হয়ে গেল। কাশীপুর পঞ্চকোটরাজ হাই স্কুলের তিন শিক্ষক চাকরি হারানোর ফলে ভৌতবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনও শিক্ষক রইলেন না।