এই সময়: প্রেয়ার শেষেই ক্লাস শুরুর কথা ছিল। সেই মতো ক্লাসরুমের দিকে এগোচ্ছিলেন শিক্ষক–শিক্ষিকারা। হঠাৎই মোবাইলের স্ক্রিনের ভেসে উঠল চাকরি বাতিলের খবর। টিচাররা জানতে পারলেন, চাকরিটাই নেই। সামনের ক্লাসরুমটা যেন অনেক আলোকবর্ষ দূরে সরে গেল নিমেষে। শহর, শহরতলি, জেলা সদর থেকে গ্রামের স্কুল — বৃহস্পতিবারের সুপ্রিম-রায়ে অনিশ্চয়তা সর্বত্র। অনেক স্কুলের এমন অবস্থা যে কিছু কিছু সাবজেক্ট পড়ানোর মতো শিক্ষকই থাকলেন না। কোথাও কোথাও গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি স্টাফের সংখ্যা হয়ে গেল শূন্য!
এমনিতেই অনেক বছর হলো নতুন নিয়োগ হয়নি। সব জায়গায় শিক্ষকের অভাব। তার উপর এক ঝটকায় প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে যাওয়ায় কী ভাবে ক্লাস হবে, কে পরীক্ষা নেবে, পরীক্ষার খাতাই বা কে দেখবে, সে সবের উত্তর নেই কারও কাছে।
কলকাতার যাদবপুর বিদ্যাপীঠে কম্পিউটার সায়েন্সের একজনই শিক্ষক ছিলেন। এ দিনের রায়ে তাঁর চাকরি গিয়েছে। ওই সাবজেক্ট নিয়ে ইলেভেনে পড়াশোনা করে জনা ষাটেক স্টুডেন্ট। ওই শিক্ষকই আবার স্কুলে এআই-ডেটা সায়েন্সও পড়াতেন। এখন কী হবে? প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রতিম বৈদ্য বলেন, ‘কী ভাবে ম্যানেজ করব জানি না! সোমবার কম্পিউটার সায়েন্সের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। সেই ক্লাস কী ভাবে শুরু হবে জানি না।’
যোধপুর পার্ক বয়েজ় স্কুলে আবার মাত্র একজন গ্রুপ ডি স্টাফ ছিলেন। বায়োলজি, কেমিস্ট্রি, ফিজ়িক্স ল্যাবের যাবতীয় কাজ করতেন তিনি। তাঁকে দিয়েই ডিআই অফিসে জরুরি কাগজপত্র আদান–প্রদানের কাজ করানো হতো। বৃহস্পতিবার কাজ হারান তিনিও। তবু এ দিন হাতের কাজ সারেন তিনি।
তা করতে করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রধান শিক্ষক অমিত সেন মজুমদারের বক্তব্য, ‘আমরা তো ভাবতেই পারছি না যে ওঁর চাকরি নেই। খুব সৎ মানুষ উনি। দিনভর কাজে ব্যস্ত। দুই সন্তান, স্ত্রী, মা–কে নিয়ে সংসার। কী ভাবে চলবে ওঁর?’ জরুরি পরিস্থিতিতে ওই কর্মীকে অস্থায়ী ভাবে বহাল রাখা যায় কি না, সে ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে স্কুল। দক্ষিণ কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশন, ভবানীপুর শাখায় পড়ুয়া ১,১২০ জন। মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ও অঙ্কের সব শিক্ষকেরই চাকরি চলে গিয়েছে। প্রধান শিক্ষক রাজা দে–র আশঙ্কা, ‘রোজকার পড়াশোনা ও পরীক্ষার খাতা কে দেখবেন, সে প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই।’
দমদমের শ্রী অরবিন্দ বয়েজ় স্কুলেরও তিনজন শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। এঁদের মধ্যে দু’জন কর্মাসের ও একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। এর ফলে স্কুলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আর কোনও শিক্ষকই থাকলেন না। প্রধান শিক্ষক অসীম নন্দ বলেন, ‘পার্ট–টাইমার রেখেই আপাতত সাবজেক্টটা চালাতে হবে।’ রাজ্য জুড়ে এ দিন একই দৃশ্য। মুর্শিদাবাদের ফরাক্কার অর্জুনপুর হাইস্কুলের ৩৫ জন, কুলতলির ভগবান চন্দ্র হাইস্কুলের ১১ জন শিক্ষকের চাকরি চলে গিয়েছে আদালতের রায়ে। ভগবান চন্দ্র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শান্তনু ঘোষাল বলেন, ‘যাঁদের ভরসায় সুন্দরবনের এই অজ গাঁয়ে পড়ুয়ারা বিজ্ঞানশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছিল, তাঁরাই থাকলেন না। সরকারের এ বার কী পদক্ষেপ করে, আমরা সে দিকেই অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছি।’
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরের কৃষ্ণপুুর হাইস্কুলে হাজার ছয়েক পড়ুয়া। আট জন শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি চলে গিয়েছে। কী ভাবে সামাল দেবেন? প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতির বক্তব্য, ‘জানি না। আমরা জরুরি ভিত্তিতে ম্যানেজিং কমিটির মিটিং দেখেছি। স্কুলের ফান্ডে এত টাকাও নেই যে পার্ট–টাইমার নিয়োগ করব।’ আপাতত এগিয়ে আসা গরমের ছুটিই তাঁদের এই সঙ্কটে ‘ত্রাতা’।