• 'আমার সারা জীবনের পরীক্ষায় ফার্স্ট হবার পুরস্কার বোধহয় এই চাকরি চলে যাওয়া...'
    ২৪ ঘন্টা | ০৪ এপ্রিল ২০২৫
  • নবনীতা সরকার: 'এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার ...'

    ৩ এপ্রিল ২০২৫। সকাল ১০:৩৪। আর পাঁচটা অন্যান্য দিনের মতোই লোকজন ব্যস্ত নিত্য কাজে। সাংবাদিকদের অফিসে খবরের ভিড়, বাসে ট্রেনে, ট্রামে, নিত্যযাত্রীদের অফিস যাওয়ার তাড়া। কারও আবার হাসপাতালে যাওয়ার তাড়া। কিন্তু তিলোত্তমা কলকাতা তখনও স্তব্ধ হয়নি। এর ঠিক পরেই সকাল ১০ টা ৩৪ মিনিটে রাজধানী দিল্লি থেকে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে এমন এক ভয়ঙ্কর খবর এল, এক লহমায় যেন চুরমার হয়ে গেল ২৬ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা-স্বপ্ন। ২৬ হাজার মানুষ।

    হ্যাঁ সংখ্যাটা ঠিকই পড়ছেন। পশ্চিমবঙ্গের ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি চলে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে। এই খবর শোনা মাত্রই কান্নার রোল, হতাশার চাপানো-উতোর, স্বজন-বৃদ্ধ বন্ধুবান্ধবদের আকুলতা আর চাকরিহারাদের বেঁচে থাকার আর্তনাদ। এবার কী হবে? মেয়ের দুধের পয়সা জোগানো থেকে, বাড়ির লোন, বাবার হাসপাতালের খরচ থেকে, ছোট বোনের বিয়ে- সবটাই তো তাঁদের কাঁধে। আর এই তাঁদের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ২৬ হাজার মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে বেছেছিলেন। দুচোখ ভরে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার।

    তাই অল্প বয়স থেকেই মন দিয়ে পড়াশোনা, ভালো রেজাল্ট, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসা এবং তারপর সেখান থেকে সাফল্য অর্জন করে চাকরি ক্ষেত্রে প্রবেশ- এই এতগুলো স্তর পেরিয়ে একজন চাকরিপ্রার্থী যখন শিক্ষক হয়ে ওঠেন, তখন সে সমাজের একটি প্রতিবিম্ব হয়ে যান। ন্যায়-অন্যায়, ঠিক ভুল শেখানোর মানদণ্ড সেই শিক্ষক। আর বিদ্যালয় থেকে যদি সেই শিক্ষককে চলে যেতে হয়, তাহলে তার থেকে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হয় না। কপালে ভাঁজ পড়ার মতোই অবস্থা কারণ পশ্চিমবঙ্গের আকাশে শিক্ষার কালো মেঘ ঘনিয়েছে। এবার পশ্চিমবঙ্গের এতগুলো সরকারি স্কুলের এতজন শিক্ষক শিক্ষিকার কী হবে? ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যতই বা কী? কে পরীক্ষা নেবে আর কেই বা খাতা দেখবে? পরিকাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম। 

    ২৬ হাজারের মধ্যে থেকেই একজন সদ্য চাকরি হারানো শিক্ষক। তাঁর সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেল- খুব ছোটবেলা থেকেই স্কুলে ফার্স্ট সেকেন্ড র়্যাঙ্ক করে এসেছেন তিনি। সারা জীবন স্কলার রেজাল্ট। শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন বলে ভালো রেজাল্ট থাকা সত্ত্বেও অন্য কোন পেশার দিকে যাওয়ার কথা ভাবেননি। অংকে অনার্স নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছেন  মালদার গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখানেও চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট।

    তারপরে একের পর এক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসা এবং সাফল্যের সঙ্গে প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। আসলে যে ভালো সে তো সবসময়ই ভালো। তাই কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাই তার সাফল্য আটকাতে পারেনি। প্রথমে প্রাইমারি স্কুলের পরীক্ষায় সাফল্য সেখানে শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হওয়া। আর তারপরেই হাই স্কুলের অংকের শিক্ষকের নিয়োগপত্র হাতে পাওয়া SSC-তে প্রথম স্থান অধিকার করে। সারা জীবন সততার সঙ্গে পড়াশোনা করে এবং সৎ স্বপ্ন দেখে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়াতে পেরে খুবই আনন্দিত এবং উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনি। 

    তারপরে দুচোখ ভরে জীবনের স্বপ্ন। নতুন বাড়ি বানানো থেকে মা-বাবাকে একটু ভালো রাখার চেষ্টা। সঙ্গে খুব ছোটবেলা থেকেই চলত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পড়ানো। তাঁর বরাবরের দারুন রেজাল্ট, ছাত্র-ছাত্রীদের আকৃষ্ট করত তাঁর কাছে অঙ্ক শেখার জন্য। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। তারপরেই ৩ এপ্রিল সকালে এল সেই দুঃস্বপ্নের মুহূর্ত। কার দোষ? কতটা দোষ? কীভাবে দোষী? কেন দোষ? এই প্রশ্নগুলোর বিশ্লেষণে তিনি যেতে চান না। তিনি শুধু একটি প্রশ্ন রেখেছেন সমাজের কাছে, সংবাদমাধ্যমের কাছে, হাজার হাজার পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে, রাজ্য সরকারের কাছে, কোর্টের কাছে যে, সারা জীবন এত সততার সঙ্গে পড়াশোনা করে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে, চাকরির পরীক্ষার এক র‍্যাঙ্ক করে চাকরি ক্ষেত্রে ঢুকে এত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে চার-পাঁচ বছর পড়ানোর পর এটাই কি তাঁর প্রাপ্য ছিল?

    তাঁর মতো আরও চাকরিহারাদের বক্তব্য, '২০১৬ সালের সমস্ত স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্যানেল ক্যানসেল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়া, ফাঁকা OMR Sheet জমা দিয়ে চাকরি পাওয়ার মতো একগুচ্ছ অভিযোগ রয়েছে কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। ঠগ বাঁচতে গাঁ উজার হবে, এই শঙ্কায় সুপ্রিমকোর্ট মুড়ি-মিছরির একদর করে পুরো প্যানেলের ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি বাতিল করে দিয়েছে। সারা রাজ্য এমনকি সারা দেশ এই খবরে তোলপাড়। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে চলেছে সেখানে পরবর্তী প্রজন্ম কোথায় যাবে কি করবে এক বড় প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে।' জীবনের এই অভিঘাতে বিধ্বস্ত শিক্ষকের শুধু একটাই প্রশ্ন 'সততার সঙ্গে পড়াশোনা করে, সততার সঙ্গে চাকরি পেয়েছি, শুধু এটাই কি আমার দোষ?' সুমনের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে ' প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা...'

     

  • Link to this news (২৪ ঘন্টা)