সুজয় মুখোপাধ্যায়
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে স্পষ্ট হয়ে যায়, ‘চাকরিটা আর নেই।’ খুদেদের শিক্ষার আলো দেখানোর দায়িত্ব যাঁদের কাঁধে, তাঁরাই চাকরি থেকে ‘বহিষ্কৃত’। কার্যত শুক্রবার থেকেই নিতে হবে না ক্লাস, পাবেন না বেতনও। কিন্তু ওই কচিকাঁচাগুলোর সঙ্গে যে চিরন্তন ভালোবাসার সম্পর্ক, তা নিয়মের বেড়াজালে আটকানো যায় না। গৌণ হয়ে যায় টাকাও। তাইই প্রমাণ করলেন রিষড়া বিদ্যাপীঠ হিন্দি স্কুল-এর চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
এসএসসি-র ২০১৬ সালের প্যানেল বাতিলের কারণে যে স্কুলে বেশি সংখ্যক শিক্ষকরা চাকরিহারা হয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম রিষড়া উচ্চ বিদ্যাপীঠ ইউনিট টু হিন্দি মাধ্যম স্কুল। আদালতের রায়ে এক লহমায় বদলে গিয়েছিল গোটা বিদ্যালয়ের চিত্র। ১৯ জন শিক্ষকের মধ্যে ১২ জনই চাকরি হারিয়েছেন। স্কুল চালানোই দায়। যার মধ্যে ইংরেজি শিক্ষক রয়েছেন তিন জন , ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক রয়েছেন দু’জন, ইতিহাসের দু’জন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান একজন, ভূগোলের একজন ও জীবন বিজ্ঞানে দু’জন শিক্ষক।
শুক্রবার নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলের দরজা খোলে। হাজির হয় ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা। এই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ২৫০০। পড়ুয়াদের কথা ভেবে স্কুলে হাজির হলেন সদ্য চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারাও।
সল্টলেক থেকে রোজ রিষড়া স্কুলে আসেন ইতিহাসের শিক্ষক দেবদত্তা বৈদ্য। কর্মস্থলে এসে বলেন, ‘প্রতিদিন স্কুলে আসি, পড়ুয়াদের ক্লাস নিই। আমি বাড়িতে বসে থাকতে পারিনি। অনেকে অনেক কথা বলেছে, কিন্তু আমি শুনিনি। শুধুমাত্র ছাত্রদের ভালবেসে আজ আমি স্কুলে এসেছি। কোনও পারিশ্রমিক হয়ত পাবো না। কিন্তু ওদের ভালোবাসাটা পাবো। সেটা অমূল্য।’
চাকরিহারা অন্য এক শিক্ষক রাজু পাণ্ডে বলেন, ‘ছ’বছর ধরে এই স্কুলে আসছি। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমাদের একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ওদের সামনেই পরীক্ষা রয়েছে, যদি ওদের মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে চলে যাই, তা হলে নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। আমরা নিজেই আজ স্কুলে এসেছি পড়াতে। সবকিছু টাকা দিয়ে হয় না। ভালোবাসার কাছে কোনও সময় পরাজিত হয় টাকা।’
এত শিক্ষকের চাকরি চলে যাওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক রোশন কুমার মাল। তিনি বলেন, ‘ক্লাস নিতে যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমনই সরকারি প্রকল্পগুলোর কাজেও সমস্যা হবে। আমি অনুরোধ করেছি, এই গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসুন।’ তিনি জানান, আরামবাগ, তারকেশ্বর, সিঙ্গুর-সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে পড়ুয়ারা আসে। স্কুল যদি বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে ছাত্রছাত্রীরা কোথায় যাবে? ৮ই এপ্রিল এই স্কুলের পড়ুয়াদের পরীক্ষা রয়েছে। আপাতত ক্লাসগুলোকে একসঙ্গে করে পড়াশোনা চালানো হচ্ছে।
তবে ক্লাস কি নিয়মিত হবে? চিন্তায় অভিভাবকরাও। অভিভাবক বিনোদ শর্মা বলেন, ‘এই পরিস্থিতি দেখে খুব দুঃখ হচ্ছে। আমাদের করারও কিছু নেই, আদালত যা নির্দেশ দিয়েছে তাতে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। কিছু শিক্ষক পড়াশোনা করাচ্ছেন। কিন্তু তাতে কী হবে ? যদি ঠিকমতো ক্লাস না হয়।’