এই সময়: সুপ্রিম কোর্টের বৃহস্পতিবারের রায়ে রাজ্যের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে এক ধাক্কায় কর্মহীন হয়েছেন ২৫,৭৫২ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী। শুক্রবার থেকে তাঁদের অনেকেই আর স্কুলে যাননি। তবে চাকরিহারা সবাই যে স্কুলে আসছেন না, তা নয়। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যাঁদের চাকরি গেল, তাঁরা কি আদৌ স্কুলে আসতে পারেন? স্কুলে এলেও তাঁরা কি এপ্রিলের বেতন পাবেন? ঠিক কবে থেকে তাঁদের চাকরি আর থাকবে না?
এই সব বিষয়ের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা অবশ্য দিয়েছে বিকাশ ভবন। স্কুলশিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকদের দাবি, শীর্ষ আদালতের রায়ের পর চাকরি যে থাকছে না, সেটা নিশ্চিত। গত বছর ২২ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের পর তবু আশা ছিল, সুপ্রিম কোর্টে গেলে কিছু সুরাহা হতে পারে। কিন্তু সুপ্রিম–রায়ের পরে সেই সুযোগ আর নেই। তবে বিকাশ ভাবনের বক্তব্য, আদালতের রায় কার্যকরী করতে রাজ্য সরকারকে আগে এই শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নিয়োগের সুপারিশকারী স্কুল সার্ভিস কমিশনকে (এসএসসি) নির্দেশ দিতে হবে।
সেই নির্দেশ হাতে পেয়ে এসএসসি এই ২৫,৭৫২ জনের নিয়োগের সুপারিশ বাতিলের আর্জি জানিয়ে মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে চিঠি দেবে। তার পর পর্ষদ প্রত্যেক প্রার্থীকে ও স্কুলকে আলাদা ভাবে চিঠি দিয়ে নিয়োগ প্রত্যাহার করবে। এই প্রক্রিয়া যতক্ষণ চলবে এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক–শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীরা যতক্ষণ না চাকরি বাতিলের চিঠি হাতে পাচ্ছেন, চাইলে তাঁরা ততদিন স্কুলে আসতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের ওই সময়ের বেতন পেতেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে কেউ যদি নৈতিক বা সামাজিক কারণে স্কুলে যেতে না চান, তা হলে সে বিষয়ে স্কুলশিক্ষা দপ্তরের কিছু বলার থাকতে পারে না।
বছরখানেক আগেই এই ২৫,৭৫২ জন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি দেবাংশু বসাকের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে। তখনও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল। তাই আইনি ভাবে এখনই স্কুল ফাঁকা হয়ে যাওয়ার কোনও কারণ দেখছে না বিকাশ ভবন। বরং এই শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের আলাদা আলাদা ভাবে বরখাস্তের চিঠি ইস্যু করতে কিছুদিন সময় লাগবে বলেই মনে করছেন শিক্ষা আধিকারিকরা।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী যে বার্তা দিয়েছেন, তাতে শিক্ষকদের কী করণীয়, কী নয়—সেটা তিনি স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন। আমাদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই যে, শিক্ষকরা স্কুলে যাচ্ছেন না।’ তা হলে কি শিক্ষক–শিক্ষিকারা স্কুলে যেতে পারেন? শিক্ষামন্ত্রীর জবাব, ‘আমি তো এমন কথা বলতে পারি না। মুখ্যমন্ত্রী মানবিক বার্তা দিয়েছেন, আমি বলছি শিক্ষকরা তাঁর উপরেই ভরসা রাখুন।’
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর বর্ধমান নিবেদিতা কন্যা বালিকা বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষিকা ও এক গ্রুপ–ডি কর্মীর চাকরি আর নেই। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকে শুক্রবার স্কুলে এসেছেন। শিক্ষিকারা ক্লাসও নিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘সুস্থ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষকতার মতো পেশা বেছে নিয়েছিলাম। সেখানে সমাজ যদি অযোগ্য করে দেয়, তা হলে আমাদের অপরাধ কোথায়?’ শুক্রবার সকালে ওই চার জনই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা স্বাগতা মণ্ডল কোনারকে ফোন করে স্কুলে আসবেন কি না, জানতে চান। প্রধান শিক্ষিকা তাঁদের জানান, এখনও স্কুলশিক্ষা দপ্তর অথবা জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (ডিআই) অফিস থেকে কোনও নির্দেশিকা পাননি। তাই স্কুলে না আসার কোনও কারণ নেই। এর পর সবাই নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে আসেন। রুটিন মেনে ক্লাসে যান তিন শিক্ষিকা। প্রতিদিনের মতো তাঁর দায়িত্ব সামলান গ্রুপ–ডি কর্মীও।
তবে এর বিপরীত ছবিও দেখা গিয়েছে রাজ্যের অনেক স্কুলে। চাকরিহারা বহু শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী স্কুলে আসেননি। ফলে স্কুল চালাতে হিমশিম খেতে হয়েছে প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষিকাদের। বর্ধমানের কৃষ্ণপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সৌমেন কোনার বলেন, ‘আমরা খুব সমস্যায় পড়েছি। চাকরিহারা শিক্ষক ও কর্মীরা স্কুলে না আসায় কী ভাবে স্কুল চালাব, তা বুঝে উঠতে পারছি না।’ দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঝাপবেড়িয়া হাইস্কুলে আড়াই হাজার পড়ুয়া। টিচার ইন–চার্জ ধরে ২২ জন শিক্ষক। তার মধ্যেই ছিলেন ২০১৬–র প্যানেলের ৮ শিক্ষক ও এক জন ক্লার্ক। ওই আট জনের মধ্যে ছ’জন স্কুলে আসেননি শুক্রবার। আবার উচ্চ মাধ্যমিকে যে তিন শিক্ষক ছিলেন তাঁদের সবারই চাকরি গিয়েছে। স্কুলের সহকারী শিক্ষক অনিমেষ হালদারের মন্তব্য, ‘দ্বাদশে ক্লাস শুরু হতে চলেছে। আর মাধ্যমিকের ফল বেরোলে কী করে একাদশে ক্লাস হবে, কে জানে!’