এই সময়: আর নিছক আশ্বাস বা মুখের কথা শুনতে নয়, মনের কথা মন খুলে বলতে চান ওঁরা!
আগামী সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়–সহ রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে নেতাজি ইন্ডোরের বৈঠকে নিজেদের যাবতীয় হতাশা, ক্ষোভ, ধোঁয়াশা, দাবির কথা শোনাতে চান তথাকথিত ‘যোগ্য’ চাকরিপ্রার্থীরা।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার ডিভিশন বেঞ্চ স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছে। এক ধাক্কায় চাকরি খুইয়েছেন রাজ্যের ২৫ হাজার ৭৫২ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী। তাঁদের মধ্যে ৬২৭৬ জনকে এসএসসি–র দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই আদালত ‘টেন্টেড’ বা ‘অযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু তাঁদের জন্য বাকি সবার চাকরি খোয়াতে হলো কার ভুলে— এই প্রশ্ন তুলে রাগ, ক্ষোভ, হতাশা বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার পরপরই উগরে দিয়েছিলেন চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীরা।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন, ‘আমি ন্যায্য বঞ্চিতদের পাশে আছি। কর্মহীনরা আমার সঙ্গে দেখা করতে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন।’ সেই আবেদনে সাড়া দিয়েই সোমবার, ৭ এপ্রিল নেতাজি ইন্ডোরে যাবেন বলে জানান মমতা। তবে চাকরিহারাদের অধিকাংশই শুক্রবার জানিয়েছেন, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সভায় গেলে মুখ্যমন্ত্রীকেও তাঁদের কথা ধৈর্য ধরে শুনতে হবে। তাঁদের অনেকে বলছেন, ‘ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে অবস্থান–ধর্নার সময়ে আমরা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে দেখা করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম। তখন সেটা সম্ভব হয়নি। এখন আমরা সব হারানোর পরে মুখ্যমন্ত্রী দেখা করতে চাইছেন! সেটা মন্দের ভালো। কিন্তু সে দিন আমাদের কথাই ওঁকে শুনতে হবে।’
স্কুল সার্ভিস কমিশন, রাজ্য সরকার এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ যাতে তথাকথিত ‘যোগ্য’দের হয়ে সঠিক ও যথাযথ নথি জমা দেয়, সেই দাবিতে ৪৭ দিন ধরে অবস্থান–ধর্নায় বসেছিল ‘যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ’। তাতে শয়ে শয়ে চাকরিজীবী নিয়মিত হাজির হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ চাকরিহারা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁরা অবশ্যই দেখা করতে যাবেন। তবে কয়েকজন চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী বলছেন, ‘আমরা সত্যি সত্যিই সোমবার নেতাজি ইন্ডোরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাব কি না, তা নিয়ে শুক্রবার জেলায় জেলায় চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষিকারা বৈঠক করছি। শনিবার এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে পারব।’
আবার কেউ জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আবেদন কে কবে করেছেন, তাঁরা সেটা নাকি জানেনই না! মঞ্চের এক জন জানিয়েছেন, তাঁদের তরফেই বৃহস্পতিবার এক প্রতিনিধি দল শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে দেখা করে এ ব্যাপারে আবেদন করেছিল। যদিও মুখ্যমন্ত্রী দুপুরেই চাকরিহারাদের অ্যাসোসিয়েশন তৈরি ও দেখা করার কথা জানিয়েছিলেন। চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষককর্মীদের অনেকেই বলছেন, ‘তাঁদের বক্তব্য, ওঁর শুকনো আশ্বাসে আর চিঁড়ে ভিজবে না। কারণ, আমরা সব হারিয়েছি। নতুন করে আর আমাদের হারানোর কিছু নেই।’ তাই এ বার তাঁরা একতরফা ভাবে নেতাজি ইন্ডোরের সভায় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে বাড়ি চলে আসবেন না। তাঁদের কথাও মুখ্যমন্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে।
এমনই এক কর্মহীন শিক্ষিকা সঙ্গীতা সাহা এ দিন বলেন, ‘নেতাজি ইন্ডোরে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের নিয়ে এই বৈঠক ডাকার কথা সংবাদমাধ্যমেই শুনেছি। আমরা যাবও। তবে শুধু ওঁর কথা শুনতে নয়। আমাদেরও অনেক কিছু বলার আছে। সেটা আমরা আমাদের মতো করেই বলব। ওঁকেও শুনতে হবে।’ সঙ্গীতার সংযোজন, ‘শুধু আমি একা বলব, তা নয়। আমাদের অনেক সহযোদ্ধাও আছেন। তাঁদেরও কিছু বলার থাকতে পারে। আমরা যদি ভুলেও যাই, তা হলে সে সব কথা ওঁরাও মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে পারেন। সে জন্য ওঁকে প্রস্তুত থাকতে হবে।’ মঞ্চের তরফে কর্মহীন শিক্ষক মেহবুব মণ্ডল জানান, তাঁদের সংগঠনের সদস্যরা নেতাজি ইন্ডোরে আদৌ যাবেন কি না, গেলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় তাঁদের অবস্থান ঠিক কী হবে, তা নিয়ে শুক্রবার পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এ দিন জেলায় জেলায় বৈঠকে বসেছেন কর্মহীনরা। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তাঁরা যাবেন কি যাবেন না, গেলে সেখানে তাঁদের বক্তব্য কী হবে, এই বৈঠকে সে সবই ঠিক হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, নবান্নে বৃহস্পতিবার মমতা বলেন, ‘যাঁরা বঞ্চিত শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী তাঁরা অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেছেন। শিক্ষামন্ত্রীকে তাঁরা অনুরোধ করেছেন, আমি যাতে তাঁদের কাছে যাই। কথা শুনতে তো কোনও দোষ নেই। আমি তাঁদের কথা শুনতে ও বলতে যাব। আপনারা ধৈর্য হারাবেন না। মানসিক চাপ নেবেন না।’ মমতার এই আশ্বাসেও কর্মহীনদের একাংশ সংশয়ে রয়েছেন। শহিদ মিনারে এক কর্মহীন শুক্রবার বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী প্রথম থেকেই পাশে থাকতে পারতেন। তা হলে এখন এই দিনটা আমাদের দেখতে হতো না। মুখ্যমন্ত্রীর এই আশ্বাসে কতটা সুরাহা হবে আমরা জানি না।’