এই সময়: কালবৈশাখীর-ই সময় এটা। তবে এ মরশুমে সে ভাবে ঝড় আসেনি। তবুও সংসার তছনছ হয়ে গিয়েছে ওঁদের। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চাকরি হারিয়েছেন ওই শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মীরা।
সেই ঝড়ের ধাক্কা লেগেছে স্কুলগুলিতেও। ওলটপালট অবস্থা সেগুলিরও। কোথাও ক্লাসের পর ক্লাস ফাঁকা। নেই ক্লাস–টিচার। নেই একাধিক ক্লাসের শিক্ষক। কোনও স্কুলে ঘণ্টা বাজানোর লোক নেই। সেই কাজ করতে হচ্ছে স্বয়ং প্রধান শিক্ষককে। চাকরি হারানোই একমাত্র কারণ কিনা জানা নেই, তেমন এক শিক্ষকের আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনাও সামনে এসেছে। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি দ্রুত সঙ্গীন হয়ে পড়েছে।
ঝাড়গ্রামের বিরিহান্ডি হাইস্কুলে শুক্রবারের ছবি দেখলে কে বলবে, এক দিন আগেও গমগম করছিল স্কুল বিল্ডিং। এ দিন স্কুল শুরু হওয়ার পরে দেখা গিয়েছে একাধিক ক্লাসে কোনও ক্লাস–টিচার নেই। টেবিলে পড়ে রয়েছে চক-ডাস্টার। একের পর এক ক্লাস পার হয়ে গেলেও শিক্ষক না আসায় রুটিন অনুযায়ী নিজেরাই পড়াশোনা শুরু করে দেয় পড়ুয়ারা। ক্লাস ফাঁকা গেলে অন্যদিন পড়ুয়ারা যেমন গোলমাল করে, এ দিন তাও দেখা যায়নি। কেমন যেন থমথমে হয়ে রয়েছে চারপাশ। ঝড়ের পূর্বাভাসের মতো। স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর চাকরিও গিয়েছে। নিজের ঘরে বসে ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে দেখা গিয়েছে প্রধান শিক্ষককে। ক্লাস শেষ হলে তাঁকেই তো ঘণ্টা হাতে বেরোতে হবে।
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে ভাড়া বাড়ি থেকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করা হয় এক যুবতীকে। তিনি স্থানীয় একটি স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষিকা। ঘটনাচক্রে সুপ্রিম-রায়ে বৃহস্পতিবার চাকরি হারিয়েছেন তিনিও। রাতে ফোনে তাঁকে না পেয়ে এক নিকত্মীয় এসে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করে ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করেন তাঁকে। ওই শিক্ষকের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরে গড়বেতায়। সংসারে তিনিই একমাত্র রোজগেরে। সম্প্রতি ডিভোর্স হয়েছে। বেশ কয়েকজনের কাছে কিছু টাকা ঋণ ছিল তাঁর। রাতে পাওনাদারেরা তাঁর বাড়িতেও গিয়েছিলেন। বাড়ির লোকেরা জানাতে পারেননি, এটি আত্মহত্যার চেষ্টা কি না। হলেও চাকরি হারানোই এর কারণ, সেটা স্পষ্ট নয়।
অন্ধকার নেমে এসেছে পশ্চিম মেদিনীপুরে চন্দ্রকোণা রোডের ধামকুড়া গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক শান্তিনাথ ভূঁইয়া এবং তাঁর স্ত্রী রুবি চোংদারের পরিবারে। ২০১৮-য় দুই পৃথক জেলায় চাকরি পেয়েছিলেন দু'জনেই। শান্তিনাথ হুগলির গোপাল চন্দ্র সেন হাইস্কুলে দর্শনের শিক্ষক। রুবি ফিজ়িক্স–এর শিক্ষকতা করতেন ওই জেলারই গোঘাট বালিকা বিদ্যালয়ে। এক রায়ে চাকরি হারিয়েছেন দু'জনেই। রুবির কথায়, 'অযোগ্যদের তালিকায় আমাদের নাম কখনও ওঠেনি। তবে কেন আমাদের চাকরি গেল? দুই বাড়িতে একাধিক দায়বদ্ধতা। কী ভাবে চালাব সংসার?'
শুক্রবার মেদিনীপুর শহরের কালেক্টরেট মোড়ে প্রতীকী পথ অবরোধ করলেন চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা। পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নার বিবেকানন্দ কন্যা বিদ্যাপীঠ স্কুলে ১৩ জন শিক্ষিকার চাকরি গিয়েছে। সেখানে আর বাংলা বিষয়ের কোনও শিক্ষিকাই নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষের চিন্তা — স্কুল কী ভাবে চলবে! গ্রাম পঞ্চায়েতের চাকরি ছেড়ে হাইস্কুলের শিক্ষক হয়েছিলেন কেশপুরের এক বাসিন্দা। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি করেছেন। লোন শুধবেন কী করে ভেবেই রাতে ঘুম গিয়েছে তাঁর।