• ইচ্ছা ছিল সংসারের অভাব মেটাবেন, স্বপ্ন ভেঙে চুরমার মেধাবী ছেলের
    এই সময় | ০৫ এপ্রিল ২০২৫
  • প্রদীপ চক্রবর্তী, শ্রীরামপুর

    বাবা ছিলেন পেশায় দিন মজুর। খুব সামান্য টাকা রোজগার করতেন। সংসারে অভাব অনটন লেগেই ছিল। তাই বলে পড়াশোনোয় কোনও দিন ফাঁকি দেননি। বরাবরই স্কুলের মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ক্লাসের সহপাঠীদের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ ছাত্র। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাঁকে আলাদা চোখে দেখতেন।

    লেখাপড়া এবং অধ্যাবসায়কে হাতিয়ার করেই এক দিন তিনি সংসারের অভাব ঘোচাবেন, ছোট বেলা থেকে এই স্বপ্নে বিভোর ছিলেন খানাকুলের রামনগরের মেধাবী যুবক লোকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মতো পদার্থ বিদ্যায় এমএসসি করার পর ২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় সফল হন। তার পর শ্রীরামপুর মাহেশ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরিতে যোগ দেন। চাকরি পাওয়ার পর তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর স্বপ্নটা বোধহয় এত দিনে সার্থক হতে চলেছে। তাঁর রোজগারের টাকাতেই হাল ফিরেছিল অভাবের সংসারে। বছর আগে তিনি বিয়ে করেছেন। স্ত্রী এবং বৃদ্ধা মা'কে নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে তাঁর জীবনে কার্যত বিপর্যয় নেমে এসেছে।

    আচমকা কর্মচ্যুত হয়ে বিমর্ষ লোকনাথ এ দিন ফোনে 'এই সময়'-কে জানান, তাঁর মা অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। তিনি খানাকুলের রামনগরের বাড়িতে থাকেন। কিডনির অসুখের জন্য তাঁর চিকিৎসা চলছে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, 'দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছি। মনে জেদ ছিল। অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ভালো ছিল। ভালোবেসেই শিক্ষকতার পেশায় এসেছিলাম। যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। আমি একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক ছিলাম। অন্যের ভুলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল।' সেই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, 'সবাই নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করছে। যোগ্যদের কথা কেউ বলছে না। এটা খুবই দুঃখের। আমাদের যে তকমা দিয়ে অসম্মানিত করা হলো এই ক্ষতি কী ভাবে পূরণ এই সময় হবে? মায়ের চিকিৎসার খরচ, গৃহ-ঋণের কিস্তির টাকা কী ভাবে পরিশোধ করব জানা নেই।'

    লোকনাথের সহকর্মী মাহেশ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিমল কোলে বলেন, 'প্রায় ছ'বছর ধরে দায়িত্ব নিয়ে বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পদার্থ বিদ্যা পড়াচ্ছেন লোকনাথ। তাঁর দক্ষতা ও পড়ানোর কৌশল নিয়ে আমাদের মনে কোনও সংশয় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা দশ জনের মধ্যে একজন লোকনাথ। অনায়াসেই সে অধ্যাপনা করতে পারত। আমরা মানবিক ভাবে লোকনাথের পাশেই আছি।' অভিভাবক সমীর দে বলেন, 'লোকনাথবাবু স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের খুব যত্ন সহকারে পড়াতেন। একবার স্কুলের বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে গিয়ে সেটা আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। উনি স্কুলে না এলে ছাত্র-ছাত্রীদের মন খারাপ হবে, এটা স্বাভাবিক।'

    লোকনাথের মতোই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চাকরি বাতিল হয়েছে শ্রীরামপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের এক ইংরেজি শিক্ষিকার। কিন্তু নিজের দায়বদ্ধতা থেকেই এ দিন স্কুলে পরীক্ষার গার্ড দিতে এসেছিলেন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তিনি বলেন, 'অযোগ্যদের তালিকায় আমার নাম ছিল না। পরীক্ষা দিয়েই সম্মানের সঙ্গে চাকরি করছিলাম। কিন্তু আদালতের নির্দেশে চাকরি যাওয়ায় নিজের নাম বলতেও দুঃখ হচ্ছে। সবার মতো আমারও পরিবার আছে। কোনও অন্যায় না করেই আমাদের এত বড় শাস্তি দেওয়া হলো। এখন বেতন বন্ধ হলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। তার দায় কে নেবে?'

  • Link to this news (এই সময়)