২৬ হাজার শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলের প্রভাব পড়ল কয়েক হাজার স্কুলে! স্কুলশিক্ষা দফতরের প্রাথমিক হিসাব কী?
আনন্দবাজার | ০৫ এপ্রিল ২০২৫
সু্প্রিম কোর্টের নির্দেশে চাকরি বাতিল হয়েছে রাজ্যের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এবং পোষিত স্কুলের প্রায় ২৬ হাজার (২৫,৫৭২ জন) শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর। তার প্রভাব পড়েছে রাজ্যের হাজার হাজার স্কুলের পঠনপাঠনে। ঠিক কত স্কুলে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তারই একটি ইঙ্গিত মিলেছে স্কুল শিক্ষা দফতরের প্রাথমিক হিসাবে। যাঁদের চাকরি বাতিল হয়েছে, তাঁদের নিয়ে কী পদক্ষেপ করা হবে, সেই বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে স্পষ্ট করে এখনও পর্যন্ত কোনও নির্দেশ দেয়নি বিকাশ ভবন। এ নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা। শিক্ষা দফতরের একটি সূত্র বলছে, এর ফলে রাজ্যের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের এপ্রিলের বেতন পাওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
নিয়ম মেনে রাজ্যে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এবং পোষিত স্কুলের শিক্ষকেরা বেতন সেই মাসের শেষ দিনে পান। ওই বেতনের জন্য স্কুলের তরফে ‘রিকুইজ়িশন’ সেই মাসেরই ১০ তারিখের মধ্যে নির্দিষ্ট পোর্টালে ‘আপলোড’ করতে হয়। এপ্রিল মাসে সেই ‘রিকুইজ়িশন’ জমা করতে গিয়েই সমস্যায় পড়ছেন বিভিন্ন স্কুলের প্রধানশিক্ষক-প্রধানশিক্ষিকারা। এপ্রিলের বেতন পাওয়ার তালিকায় কাদের রাখবেন, চাকরিহারাদের রাখবেন কি না, সেই নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে এই সংক্রান্ত কোনও নির্দেশিকা দেয়নি রাজ্য শিক্ষা দফতর। রাজ্য শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কর্তৃপক্ষ যখন এই বেতনপ্রাপকদের তালিকা তৈরি করছেন, তখন ‘প্রভাবিত’ স্কুলগুলির একটি পরিসংখ্যান তাদের কাছে আসতে শুরু করেছে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নবম-দশম শ্রেণির ১২,৯৪৬ জন শিক্ষক, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ৫,৭৫৬ জন শিক্ষক, ২,৪৮৩ জন গ্রুপ সি কর্মী এবং ৪,৫৫০ জন গ্রুপ ডি কর্মীর চাকরি গিয়েছে। এই সংখ্যার যোগফলের পরেও রাজ্যের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এবং পোষিত স্কুলে আরও কয়েক জনের চাকরি গিয়েছে। শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যের স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়াতেন এমন শিক্ষকদের চাকরি শীর্ষ আদালতের রায়ে বাতিল হওয়ার প্রভাব পড়তে পারে প্রায় ৩,১২৫টি স্কুলে। নবম-দশম স্তরে পড়াতেন এমন শিক্ষকদের চাকরি বাতিলের প্রভাব পড়তে পারে ৫,৪২৬টি স্কুলে। গ্রুপ সি কর্মীদের চাকরি বাতিলের জের পড়তে পারে ২,২১৫টি স্কুলে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গ্রুপ ডি কর্মীদের চাকরি বাতিলের প্রভাব ৩,৮৮৫টি স্কুলে পড়তে পারে বলে স্কুলশিক্ষা দফতর সূত্রে খবর। এর মধ্যে এমন স্কুল রয়েছে, যেখানে একাধিক শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীর চাকরি গিয়েছে। ফলে চাকরি যাওয়ার প্রভাব আদতে মোট কত সংখ্যক স্কুলে পড়েছে, তা এখনও জানা যায়নি।
প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী চাকরি হারানোর কারণে বিপাকে পড়েছে স্কুলগুলি। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলি বিশেষত। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে এমন অনেক নতুন বিষয় পড়ানো হয়, যেগুলি মাধ্যমিকে পড়ানো হয় না। সেই সব বিষয়ের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে এক জন করে শিক্ষকই সাধারণত নিযুক্ত থাকেন। অনেক স্কুলেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নির্দিষ্ট বিষয়ের এক জন মাত্র শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। সে সব স্কুলে পড়ুয়াদের ওই বিষয়গুলি কী ভাবে পড়ানো হবে, এখন সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার মাঝে বেতনপ্রাপক শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের তালিকা তৈরি করতে গিয়েও বিপাকে পড়ছেন স্কুলের প্রধানশিক্ষকেরা বলে খবর। কোনও মাসের বেতনের জন্য ‘রিকুইজ়িশন’ সরকারি পোর্টালে জমা দিতে হয় প্রধানশিক্ষকদের। সার্ভিস বুকে যাঁদের নাম রয়েছে, প্রত্যেকের তথ্যই দিতে হয়। যাঁদের চাকরি বাতিল হয়েছে, তাঁদের তথ্য কি পোর্টালে দেওয়া হবে, সেই নিয়ে ধন্দে প্রধানশিক্ষকেরা। কারণ এই নিয়ে এখনও পর্যন্ত রাজ্য সরকারের তরফে কোনও নির্দেশ আসেনি। অন্য দিকে, নির্দিষ্ট সরকারি পোর্টালে সময়মতো সেই তথ্য ‘আপলোড’ করা না হলে নিয়মিত শিক্ষকদেরও বেতন পাওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে খবর।
বাঙুর স্কুলের প্রধানশিক্ষক সঞ্জয় বড়ুয়া বলেন, ‘‘সরকার থেকে কোনও নির্দেশ না আসায় তথ্য আপলোড করতে দেরি হচ্ছে স্কুলগুলির। সময়মতো সেই তথ্য আপলোড না করলে চাকরিরত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের বেতন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’’
বেশির ভাগ স্কুল কর্তৃপক্ষই জানাচ্ছেন, তাঁরা সরকারের এই সংক্রান্ত নির্দেশিকার অপেক্ষায় রয়েছেন। যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধানশিক্ষক পার্থপ্রতিম বৈদ্য বলেন, ‘‘আমরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি।’’ বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘শিক্ষা দফতর থেকে এখনও পর্যন্ত স্কুলগুলিতে কিছু না জানানোর কারণে নিয়মিত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের বেতন সংক্রান্ত একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। যেহেতু শিক্ষা দফতরের কমিশনারের এই কাজটা করা উচিত, তাই আমরা কমিশনারকে এই বিষয়ে অবহিত করেছি। আশা করি তিনি সঠিক জায়গায় কথা বলে এই জটিলতা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ করবেন। সুপ্রিম কোর্টের অর্ডার তো কেউ অমান্য করতে পারেন না।’’
প্রসঙ্গত, যে সরকারি পোর্টালে বেতন সংক্রান্ত তথ্য প্রধানশিক্ষকদের ‘আপলোড’ করতে হয়, তা আপাতত বন্ধ। সূত্রের খবর, প্রযুক্তিগত কারণে বন্ধ রয়েছে পোর্টালটি। পোর্টাল খুললে চাকরিরত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের বেতন নিয়ে কী পদক্ষেপ করা হবে, সেই নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর, এখন যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তার পরেই সেই সংক্রান্ত নির্দেশ দিতে পারে শিক্ষা দফতর। স্কুলগুলির প্রধানশিক্ষকদেরও চাকরিহারা শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, বিশেষ ভাবে সক্ষমদের তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দিতে পারে তারা। তবে কী করা হবে, তা নিয়ে এখনও স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি শিক্ষা দফতর।