ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে বিদ্যালয়ে চাকরি, হতাশায় চাকরিহারা মেধাবী ছাত্র
দৈনিক স্টেটসম্যান | ০৬ এপ্রিল ২০২৫
‘একের জন্য দশের মরণ’, এই প্রবাদই যেন সত্য প্রমাণিত হচ্ছে রাজ্যে। ২০২৪ সালের ২২ শে এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্ট প্রায় ২৬ হাজার জন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষা কর্মীর চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল। সেই নির্দেশেই অনড় থেকেছে শীর্ষ আদালতও। এর ফলে রাজ্যের সর্বত্র হতাশা এবং হাহাকারের চিত্র সামনে আসছে। বিভিন্ন জেলার সরকারি স্কুলগুলির বহু শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি বাতিল হয়েছে। পুরুলিয়ায় চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৪৫০ এর বেশি শিক্ষক-শিক্ষিকা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের পর সামান্য অক্সিজেন মিললেও সামাজিক অসম্মানের আবহ থেকে বেরোতে পারছেন না অনেকেই। বৃহস্পতিবার পুরুলিয়ার বিজ্ঞান কেন্দ্রের কাছে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েন বাতিলের তালিকায় থাকা শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষা কর্মীরা। তালিকায় রয়েছে পিএইচডি করা সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্কুল সার্ভিস কমিশনের মেধা তালিকায় থাকা ইংরেজিতে সারা রাজ্যের প্রথম শুভাশিস পান, ইতিহাসে রাজ্যের মধ্যে সপ্তম স্থান অধিকারী রঞ্জন মাহাতো। এমনকি স্কুলের প্রথম থেকে পঞ্চম স্থানাধিকারী মেধাবী ছাত্ররাও এই তালিকায় রয়েছেন। বাদ পড়েননি অন্য কোনো উচ্চশিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে পারিবারিক চাপে সরকারি চাকরিতে যোগদান করা মেধাবী ছাত্রও।
আর চাকরি নেই! বর্তমানে এটিই পুরুলিয়ার টঁটারি কেন্দাডি হাই স্কুলের এক শিক্ষা কর্মীর জীবনের রূঢ় বাস্তব! পুরুলিয়া জেলার বাসিন্দা রাহুল রজক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে ২০১৬ সালের প্যানেলে ২০১৮ সালে শিক্ষা কর্মী হিসেবে একটি স্কুলে যোগদান করেছিলেন। এর আগে তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন কল্যাণী গভর্মেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। কিন্তু পারিবারিক চাপে মাঝপথেই ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে রাজ্য সরকারের চাকরির জন্য ফর্ম ফিলাপ করেন। লিখিত পরীক্ষা, টাইপিং পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা অর্জন করে ২০১৮ সালে হাই স্কুলের ক্লার্কের চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের রায় চাকরি হারিয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েছেন তিনি। অন্যদিকে, একসময়ের প্রথম থেকে পঞ্চম স্থান অধিকারী, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের বি কম অনার্সের ছাত্র তাপস মন্ডল কাশিপুর ব্লকের কালিদহ হাইস্কুলে অশিক্ষক পদে চাকরি পেয়েছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ বিচার ব্যবস্থার ওপর তাঁর আশা ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবারের রায় ঘোষণার পর একেবারে ভেঙে পড়েন তিনি।
কমিশনের পরীক্ষায় ইংরেজিতে রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করা শিক্ষক শুভাশিস পানের বক্তব্য, তিনি গাড়াফুসড়া হাই স্কুলে নবম ও দশম শ্রেণীর ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। সুপ্রিম কোর্টের রায় তাঁরা আশঙ্কিত। এই ধরনের রায় কেউই আশা করেননি। এই রায়ে বলা হয়েছে যাঁরা দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছে তাঁদের টাকা ফেরত দিতে হবে ১২% সুদে। এক্ষেত্রে উল্টো কথাটা এটাই দাঁড়ায় যাঁরা দুর্নীতি করেননি তাঁরা দুর্নীতি মুক্ত। তাই একটাই প্রশ্ন, কিছু দুর্নীতি পরায়ণ মানুষের জন্য আজকে যোগ্য ব্যক্তিরা সকলেই শাস্তি পাবে কেন? কোনো কোনো চাকরিহারা শিক্ষক বা শিক্ষা কর্মীরা জানিয়েছেন, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের পাশে থাকার কথা বলেছেন। সেই আশা, ভরসা এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস তাঁদের এখনও রয়েছে। হতাশাগ্রস্ত বহু মানুষ। কারও ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া রয়েছে, কারও বাড়িতে রয়েছে ছোট সন্তানেরা। কেউ আবার বৃদ্ধ মা-বাবা নিয়ে কিভাবে দিনযাপন করবেন সেই চিন্তায় রয়েছেন। সকলের কপালেই চিন্তার ভাঁজ।