• ‘জামাইষষ্ঠীতে কী ভাবে মুখ দেখাব শ্বশুরবাড়িতে’, চিন্তা চাকরিহারা দিবাকরের
    এই সময় | ০৬ এপ্রিল ২০২৫
  • প্রশান্ত ঘোষ, ভাঙড়

    স্কুল শিক্ষক বলে পাড়ার যে কোনও অনুষ্ঠানে তাঁকে মোটা টাকা চাঁদা দিতে হতো। শুধু টাকা দেওয়াই নয়, গ্রামের যে কোনও পুজো-পার্বণ কিংবা অনুষ্ঠানে তাঁকে সামনের সারিতে দেখা যেত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে এসএসসি মামলার রায় বেরনোর পরে তাঁর জীবনে বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। শনিবার সকাল থেকে পাড়ায় শুরু হয়েছে হরিনাম সংকীর্তন। কিন্তু মঙ্গলপুর গ্রামের মেধাবী যুবক দিবাকর মণ্ডল সংকীর্তনের আসর থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। চোখের জল ফেলতে ফেলতে বই-খাতার ধূলো ঝাড়ছেন।

    সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যে ২৬ হাজার স্কুল শিক্ষকের চাকরি চলে গিয়েছে, তাঁদেরই এক জন দিবাকর। চাকরি হারিয়ে তাঁর মন আজ বিষন্ন। বইয়ের ধুলো ঝাড়ার ফাঁকে বললেন, ‘অনেক লড়াই, সংগ্রাম করে শিক্ষকের চাকরি পেয়ছিলাম। এক ঝটকায় সব শেষ হয়ে গেল।’ তবে আর পাঁচজন চাকরিহারাদের মতো এখনই ভেঙে পড়তে নারাজ। দৃপ্ত কণ্ঠে জানালেন, ‘হাল ছাড়ছি না। আবার লড়াই করব। লড়াইয়ের ময়দানে থাকব। তাই নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছি।’

    মঙ্গলপুর দুর্গা মন্দিরের কাছে আমবাগানের মধ্যে বাড়ি দিবাকরের। বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান। বাবা তরণী মণ্ডলকে এলাকার মানুষ বিড়ি শ্রমিক বলেই চেনেন। কয়েক বছর আগেও টালির ছাউনি দেওয়া একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকতেন দিবাকররা। মহাজনের কাছে বাবা বিড়ি বেঁধে যে সামান্য টাকা উপার্জন করতেন, তা দিয়েই ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে দিবাকর সব শখ-আহ্লাদ ছেড়ে রাতদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ২০০৯ সালে ভাঙড় কলেজে ইতিহাসে টপার হন তিনি। আধুনিক ইতিহাসে মাস্টার্স করার পর বিএড করেন। গেস্ট লেকচারার হিসেবে ভাঙড় কলেজে পড়াতেন।

    ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বসেন। পরের বছর নেট, সেট পাশ করেন। ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন এবং উত্তর ২৪ পরগণার বাছড়া এমসিএইচ হাই স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পান। তিনিই ছিলেন স্কুলের এক মাত্র ইতিহাসের শিক্ষক। দিবাকরকে নিয়ে এক সঙ্গে ৯ জন শিক্ষক ওই স্কুলে যোগদান করেছিলেন। বিদ্যাধরী নদী পেরিয়ে নৌকায় চেপে প্রতিদিন ওই স্কুলে যেতে হয় শিক্ষকদের। দুর্গম এলাকা বলে বাকি ৮ জন শিক্ষক উৎসশ্রীর মাধ্যমে অন্যত্র বদলি হয়ে গেলেও ছাত্রদের ভালোবাসার টানে স্কুল ছাড়তে পারেননি দিবাকর। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তিনি আজ স্কুল ছাড়তে বাধ্য হলেন।

    দিবাকর জানিয়েছেন, চাকরি পাওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁদের ভিটে, বাড়ি বলে কিছুই ছিল না। চাকরি পাওয়ার পর দুটো সংস্থা থেকে লোন নিয়ে জমি কেনেন। পরে সেখানে বাড়ি করেন। এর মধ্যেই বাবা-মা কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। তাঁদের চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা বেরিয়ে গিয়েছে। তার জন্যও আবার বাজার থেকে টাকা ধার নিতে হয়েছে দিবাকরকে। গত ডিসেম্বরে তিনি বিয়ে করেন। স্কুল শিক্ষক দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন মেয়ের বাড়ির লোক। দিবাকরের চাকরি চলে যাওয়ায় তাঁরাও ভেঙে পড়েছেন। জামাইষষ্ঠীতে কী ভাবে মুখ দেখাবেন শ্বশুর বাড়িতে, সেই ভাবনাও মাথায় ঘুরছে দিবাকরের। তিনি বলেন, ‘বাড়ির সবাইকে সান্তনা দিচ্ছি। আদালত বলেছে, তিন মাসের মধ্যে পরীক্ষা হবে। তাই এক দিনও সময় নষ্ট না করে নতুন করে আবার পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করেছি।’

    ছেলের চাকরি চলে যাওয়ায় কেঁদে ভাসাচ্ছেন দিবাকরের মা ভবানী মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে লোকের কাছ থেকে জামা, বই, খাতা নিয়ে পড়াশোনা করেছে। ওর বাবা মুখে রক্ত তুলে ওকে মানুষ করেছে। আজ যোগ্য-অযোগ্যের বিচার হবে না? সবার চাকরি যাবে? এ কেমন বিচার?’

    দিবাকরের প্রতিবেশী সুদীপ মণ্ডল বলেন, ‘এসএসসির প্রথম প্যানেলে দিবাকরের নাম ছিল। ১৩০ র‍্যাঙ্ক করেছিল। বাজারে লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ আছে। কী করে চলবে ওদের?’ বাছড়া এমসিএইচ হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক উৎপল বর্মন বলেন, ‘আমাদের স্কুলে সব মিলিয়ে ২৫ জন স্থায়ী শিক্ষক ছিলেন। এক ঝটকায় ৯ জনের চাকরি চলে গিয়েছে। এখন যে ক'জন আছেন, তাঁদেরকে দিয়ে স্কুল চালানো কঠিন। বিচার ব্যবস্থা আর সরকারের দিকে তাকিয়ে আমরা।’

  • Link to this news (এই সময়)