• ইস্কোর সেই কুলিং টাওয়ার আর নেই, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মাটিতে মিশল বহু স্মৃতিও
    এই সময় | ০৬ এপ্রিল ২০২৫
  • বিশ্বদেব ভট্টাচার্য

    মাত্র কয়েক সেকেন্ডে মাটিতে মিশিয়ে দেও‌য়া হলো ইস্কোর কুলিং টাওয়ারগুলি। কিন্তু তার জন্য রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছিল আগেই। সবটাই হলো নিখুঁত ভাবে। রবিবার দুপুর ১২টা ১২মিনিটে হঠাৎ বেজে উঠল সাইরেন, এর পরেই শুরু কাউন্টডাউন। ১০ থেকে উল্টো কাউন্ট ডাউন শুরু করে শূন্য উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল আসানসোল। গুঁড়িয়ে গেল ৫টি টাওয়ার। সেই কুলিং টাওয়ারগুলি এখন শুধুই ইতিহাস। চোখ ভিজল অনেকের। চৈত্রের গরমে সেখানকার কর্মী, আসানসোলবাসীর মনে তখন বইছে, মন খারাপের ‘লু’।

    শনিবারই টাওয়ারগুলির গায়ে লাগানো হয়ে গিয়েছিল বিশেষ যন্ত্র। আসানসোলের অন্যতম পরিচিত ইস্পাত কারখানা (ইস্কো)-র ভেতরে থাকা কুলিং টাওয়ারগুলি ভাঙার কাজ শুরু হয় রবিবার দুপুর ১২টা নাগাদ।

    বিস্ফোরণের মাধ্যমে তা মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কারণ সেই ইস্পাত কারখানার সম্প্রসারণের কাজ চলছে। কুলিং টাওয়ার ভাঙার কাজ শেষ হয় বেলা ১২টা ১৫ মিনিট নাগাদ। ইস্কোর (ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেড) সেই সুবিশাল কুলিং টাওয়ারের দেখা এখন শুধু মিলবে ক্যানভাস, ছবি আর স্মৃতিতে।

    এই টাওয়ারগুলি কারখানার প্রাচীর থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত। ফলে প্রাচীরের বাইরে কোনও প্রভাব পড়েনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে জেলাশাসক থেকে শুরু করে উচ্চ পদস্থ পুলিশ আধিকারিকদের বিষয়টি জানানো হয়। এছাড়াও সিআইএসএফকেও বিষয়টি জানানো হয়েছিল।

    এ দিন ১১টা ৫৫ মিনিট থেকেই সকলকে সতর্ক করতে পর পর ৩০ মিনিট ধরে সাইরেন বাজানো হয়। ১২টা নাগাদ সুরক্ষাকর্মীদের সতর্ক করা হয় যাতে সেই সময়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব সকলে বজায় রাখেন। ১২টা ৫ মিনিটে শুরু হয় চূড়ান্ত প্রস্তুতি আর ভিডিয়ো রেকর্ডিং। ১২টা ১০ মিনিটে সুরক্ষা ব্যবস্থার খুঁটিনাটি নিশ্চিত করা হয়। এর পর ১২টা ১২ মিনিটে সমন্বয়ের জন্য সাইরেন বাজানো হয়। ১২টা ১৫ মিনিটে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় টাওয়ারগুলি।

    দুই বাঙালি শিল্পপতির বহু স্বপ্ন আর পরিশ্রমের ফসল এই ইস্কো কারখানা। রাজেন্দ্রপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর পুত্র বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই আসানসোল পরিণত হয়েছিল ইস্পাত শিল্প হাবে। সেই সময়েই তৈরি হয়েছিল এই কুলিং টাওয়ারগুলি। ১৯২২ সাল থেকে এই টাওয়ারগুলি তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৯৩৬ সালের মধ্যে পাঁচটি টাওয়ার তৈরি করা হয়।

    বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, কুলিং টাওয়ার হলো একটি বিশেষ তাপ এক্সচেঞ্জার। এগুলি তাপ পরিবর্তনেও ব্যবহার করা হয়। জলের তাপমাত্রা কমাতে বায়ু এবং জলকে একে অন্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কে আনা হতো এই টাওয়ারে। এর পর প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। এখন আর সেই পদ্ধতিতে কাজ হয় না কারখানার অন্দরে। ফলে সেই অর্থে এই কুলিং টাওয়ারগুলি ‘অকেজো’-ই ছিল। তবে এর নীচে বিশ্রাম নিতেন অনেকে। কেউ কেউ তা দূর থেকে দেখতে আসতেন।

    প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বিনিময়ে ইস্কো কারখানার আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে। সেই কাজ শেষ হলে ইস্কোর বর্তমান উৎপাদন আড়াই মিলিয়ন টন থেকে বাড়িয়ে সাত মিলিয়ন করা হবে। আর এই নতুন প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন প্রচুর জায়গার। সেই কারণেই এই কুলিং টাওয়ারগুলি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।

    দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসা হয়েছিল এই কুলিং টাওয়ার ভাঙার জন্য। বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ইস্কোর জনসংযোগ দপ্তরের আধিকারিক ভাস্কর কুমার জানিয়েছিলেন, ইস্কোর রিভার সাইড টাউনশিপ এবং রিভার ব্যাঙ্ক অঞ্চলের দুটি সাব স্টেশনেই বিদ্যুৎ সরবরাহ সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত বন্ধ রাখা হবে এ কাজের জন্য।

    এ দিকে এই কুলিং টাওয়ারগুলিকে শেষবারের মতো দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন বহু মানুষ। প্রায় সাড়ে তিনশো কেজি বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয় তা ধ্বংস করার জন্য। সেই সময়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে প্রত্যেককে সরিয়ে দেওয়া হয়।

    ভেজা চোখে আসানসোলের বাসিন্দা মাম্পি রায় বলেন, ‘জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই কুলিং টাওয়ারগুলোকে দেখছি। বাইরে গেলে সকলকে গর্ব করে বলতাম, গম্বুজের মতো টাওয়ার রয়েছে আমার শহরে। সেই পরিচিতিটা হারিয়ে গেল।’

  • Link to this news (এই সময়)