সঞ্জয় চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি
এখন যেখানে শিলিগুড়ির ব্যস্ততম বাজার বিধান মার্কেট, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তেমনটা ছিল না। বরং অনেকটাই জলা জমি। তার পাশে অজস্র কাঠের বাড়ি। বাংলাদেশ থেকে বাবার হাত ধরে এ পারে এসে শিলিগুড়িতেই উঠেছিলেন শিলিগুড়ির বিশিষ্ট ভ্রমণ কাহিনির লেখক তথা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য। বিধান মার্কেটের কাছে একটি কাঠের বাড়িতে সপরিবারে আশ্রয় নেন তাঁরা। আগাগোড়া কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়ি। টিনের চাল। তখন তো প্রায় সারা বছর বৃষ্টি হতো শিলিগুড়িতে। বৃষ্টি নামলেই গৌরীশঙ্কর সোজা উঠে পড়তেন বিছানায়। চাদরে মুখ ঢেকে শুনতেন টিনের চালে অঝোরধারার বর্ষণ-সঙ্গীত। পরে তাঁরা যখন হাকিমপাড়ায় চলে আসেন তখনও চারপাশে সেই কাঠের বাড়ি। সেই টিনের চাল। তালে তালে বৃষ্টির নাচানাচি।
আজও সেই আক্ষেপ যায়নি অবসরপ্রাপ্ত ওই শিক্ষকের। তাঁর কথায়, ‘সত্যি, কী ভাবে বদলে গেল শিলিগুড়ি! আগে প্রায় প্রতিটি বাড়ি ছিল কাঠ দিয়ে তৈরি। কেউ ইট, বালি, সিমেন্ট দিয়ে বাড়ি তৈরি করতেন বটে। তবে, তাঁদের আমরা বাইরের লোক ভাবতাম। শিলিগুড়ির লোক আবার ইট দিয়ে বাড়ি বানাবে কেন? সেই শিলিগুড়িতে এখন কাঠের বাড়ি খুঁজে খুঁজে বার করতে হয়।’
আসলে ভূমিকম্পপ্রবণ শিলিগুড়িতে একটা সময়ে কাঠের বাড়িই ছিল দস্তুর। কাঠের বাড়ি তৈরি করার মিস্ত্রির অভাব মেটাতে ব্রিটিশরা চিন থেকে কাঠমিস্ত্রি নিয়ে এসেছিলেন। ব্রিটিশ অফিসারদের কাঠের বাংলো তৈরির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বাড়িও তৈরি করতেন তাঁরা। ভূমিকম্পের সময়ে কাঠের বাড়িতে ক্ষয়ক্ষতি খুবই কম হয়। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক প্রবল ভূমিকম্পে ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে কাঠের বাড়ি। উত্তরবঙ্গেরও সেই হাল হবে কি না সেই ভয়ে কাঁপছেন অনেকেই।
২০০০ সালে শিলিগুড়িতে প্রোমোটার অ্যাক্ট চালু হতেই লোকে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল বহুতলের দিকে। সেই প্রবণতা এখন শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে ফুলবাড়ি, মাটিগাড়া, নকশালবাড়ি অবধি পৌঁছে গিয়েছে। বিজ্ঞান ভুলে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে অনেকেই হয়তো বহুতলে মাথা গুঁজেছেন। কিন্তু সকলে নয়। শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার বাদল সরকারের কথাই ধরা যেতে পারে। পেশায় কাঠের ব্যবসায়ী ছিলেন। চেরাই কাঠ দিয়ে আজ থেকে প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে হাকিমপাড়ায় দোতলা কাঠের বাড়ি তৈরি করেন। সামনে ফুলের বাগান।
পৃথিবী উল্টে গেলেও বাগানে জল দিতে ভুল হতো না তাঁর। এখন বয়স হয়েছে। স্মৃতি অনেকটাই লোপ পেয়েছে। কিন্তু কাঠের বাড়ির বদল হয়নি। তাঁর স্ত্রী তপতী সরকার বলেন, ‘আগে শিলিগুড়ির বাড়িঘর এমনই ছিল। সবারই ছিল কাঠের বাড়ি। এখন তো দেখি চারদিকে বহুতল। আমরা বাড়িটা একই রেখেছি।’ বৃদ্ধ বয়সেও সুযোগ পেলেই রিকশায় চেপে গোটা শহর চষে বেড়ান গৌরীশঙ্কর। তিনি বলেন, ‘শিলিগুড়িতে এখনও অন্তত আট থেকে দশটা কাঠের বাড়ি রয়েছে যেখানে লোকজন বাস করেন। আসলে কাঠ এখন সোনার মতো দামি হয়ে যাচ্ছে। লোকের আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বিপদের কথাটাও মাথায় রাখা দরকার।’ তাংর সংযোজন, ‘মিয়ানমারে একটা সময়ে সবই ছিল কাঠের বাড়ি। ওখানকার সেগুন কাঠ ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। ‘বার্মা টিক’ মানে সারা জীবন ঘুণ ধরবে না, এমন কাঠ। আজও চোরাপথে শিলিগুড়িতে আসে বার্মা টিক। কিন্তু বার্মা আধুনিক হতে গিয়ে কাঠ ছেড়ে বহুতলে ঝুঁকেছিল। শিলিগুড়িও তাই।’