এই সময়: সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের সঙ্গে আজ, সোমবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে, রবিবার শহিদ মিনার চত্বরে জমায়েত করেন কর্মহারা শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীরা। রবিবার রাতটা খোলা আকাশের নীচে কাটান এঁদের অনেকে। আজকের মিটিংয়েও যাবেন তাঁরা। তবে সেই সঙ্গেই দিয়ে রেখেছেন একাধিক হুঁশিয়ারি।
রাজ্য সরকারের উদ্দেশে তাঁদের বার্তা — কোনও ভাবেই অন্য কৌশলে ভুলবেন না তাঁরা। যাঁরা যেখানে যে ভাবে চাকরি করছিলেন, সেই চাকরিই তাঁদের ফিরিয়ে দিতে হবে। এঁদের দাবি, কোনও নেতা–মন্ত্রী বা কাউকে টাকা দিয়ে এই চাকরি মেলেনি। চাকরি পেয়েছেন নিজেদের যোগ্যতায়। পাশাপাশি তাঁরা জানান, ভাতা, অস্থায়ী কাজ বা অন্য কোনও সরকারি অফিসে চাকরির প্রস্তাব মানা হবে না। ন্যায্য বেতনের কথাই মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরা হবে। তা ছাড়া, নিজেদের ‘যোগ্যতা’ প্রমাণে আর কোনও পরীক্ষাতেও বসতে চান না এই ‘যোগ্য’ শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীরা। তাঁরা এ কথাও জানিয়েছেন যে, আজকের বৈঠকে যদি ‘অযোগ্যদের’ তালিকায় নাম থাকা কোনও ক্যান্ডিডেটকে দেখতে পাওয়া যায়, তা হলে বৈঠকের মধ্যেই ঝামেলা বাধাবেন। প্রয়োজনে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়েও যাবেন ‘যোগ্যরা’।
মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীর পাশাপাশিই রাজ্যের আরও কয়েক জন হেভিওয়েট মন্ত্রীর থাকার কথা আজকের বৈঠকে। আমন্ত্রণ পেয়েছেন তৃণমূলপন্থী স্কুল ও কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–সংগঠনের অনেকে। একটি সূত্রের দাবি, বেশ ক’জন লেখক, বুদ্ধিজীবী, চিত্রশিল্পীও আমন্ত্রণ পেয়েছেন বৈঠকে। কিন্তু মিটিংয়ে তাঁদের ঠিক কী ভূমিকা থাকবে, সেটা নিশ্চিত করা যায়নি। আমন্ত্রণ পেয়েছেন সাহিত্যিক আবুল বাশার। তিনি বলেন, ‘কেন আমাদের ডাকা হয়েছে, সেটা ওখানে গেলে বুঝতে পারব।’
শিক্ষা দপ্তর সূত্রে খবর, সমস্যা সমাধানে চাকরিহারাদের কাছে বেশ কিছু প্রস্তাব রাখবেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রয়োজনে প্রস্তাবগুলি নিয়ে আলোচনা ও মতামত সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট সময়ও দেওয়া হবে। দপ্তরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘বেশ কিছু সুরাহার প্রস্তাব নিয়ে খোলা মনে আলোচনা করতে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। কোনও প্রস্তাবই একপাক্ষিক রাখা হবে না। মতামত নেওয়া হবে।’
গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এক লপ্তে চাকরি হারান রাজ্য সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী। যোগ্য–অযোগ্য ভাগাভাগি করা যায়নি। তাই পুরো প্যানেল বাতিল করতে হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও তাঁর বেঞ্চ। যদিও রায়েই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ২৬ হাজারের মধ্যে ৬,২৭৮ জন ‘টেন্টেড’ বা অযোগ্য। তাঁদের বেতন ফেরানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। সে দিন রায়ের পরেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সোমবার নেতাজি ইন্ডোরে চাকরিহারাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুরও দাবি, মানবিক ও রাজনৈতিক ভাবে ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের পাশে আছেন তাঁরা।
বিরোধী দলগুলি মনে করছে, তৃণমূলের দুর্নীতির কারণে চাকরি হারিয়েছেন যোগ্য শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীরাও। রবিবার শহিদ মিনার চত্বর থেকে সরকার ও বিরোধী সব পক্ষের উদ্দেশেই চাকরিহারাদের তরফে মহম্মদ মেহবুব মণ্ডল বলেন, ‘এত মায়া–কান্না না কেঁদে, আমাদের ব্যবহার করে ভোটে জিততে না–চেয়ে শাসক ও বিরোধীরা এক সঙ্গে বসুন। সকলে মিলে প্রয়োজনে ফের সুপ্রিম কোর্টের কাছে যান বা অন্য কোনও রাস্তা বের করে আমাদের চাকরি ফিরিয়ে দিন।’ যতক্ষণ তা না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে তিনি জানান।
রাজ্যের হাজার হাজার চাকরিহারা শিক্ষক, তাঁদের পরিবার, স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, অভিভাবকরাও আজ মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের দিকে তাকিয়ে। একসঙ্গে এত শিক্ষকের চাকরি যাওয়ায় স্কুলে স্কুলে যে হাহাকার, শিক্ষকের অভাব তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গেই চাকরিহারাদের যন্ত্রণা উপশমে মুখ্যমন্ত্রী কোন পথ বাতলান, সে দিকেই নজর সকলের। কিন্তু চাকরিহারাদের তরফে চিন্ময় মণ্ডল স্পষ্টই বলেন, ‘অন্য কোনও স্টপ গ্যাপ ব্যবস্থা, আমাদের অস্থায়ী হিসেবে রেখে দেওয়া, কাজ না করিয়ে একককালীন টাকা দেওয়া, ভাতার ব্যবস্থা করার মতো কৌশল যেন না নেওয়া হয়। আপনাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণে আমাদের চাকরি গিয়েছে। আমরা কোনও দুর্নীতি করিনি। কাউকে টাকা দিইনি। তাই আমাদের চাকরি যেমন ছিল, যে ভাবে, যেখানে আমরা কাজ করতাম, সে ভাবেই যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়।’ তাঁর সংযোজন, ‘২৬ হাজার, ২৬ হাজার করতে করতে আপনারা যোগ্য ১৯ হাজারের চাকরিটাও খেয়েছেন। আর আমরা এ সব কথা শুনতে চাই না।’
চিন্ময়–মেহবুবদের অভিযোগ, তাঁরা খবর পেয়েছেন যে সোমবারের বৈঠকে ‘যোগ্য’দের পাশাপাশি চিহ্নিত ‘অযোগ্য’দেরও ডাকা হচ্ছে। তেমনটা হলে নেতাজি ইন্ডোরেই বিক্ষোভ করবেন বলে জানান এঁরা। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, নেতাজি ইন্ডোরে যোগ দেওয়ার জন্য পাস দেওয়ার ব্যবস্থা চাকরিহারাদেরই একটি বিশেষ সংগঠনকে দেওয়া হয়েছে। যা নিয়ে অন্যান্য সংগঠনগুলির মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
রবিবার সুপ্রিম–রায়ের বিরুদ্ধেও একাধিক সমালোচনামূলক কথা উঠে আসে চাকরিহারাদের তরফে। এঁদের বক্তব্যের মূল নির্যাস — যে অপরাধ তাঁরা করলেনই না, সে অপরাধে কেন তাঁদের চাকরি যাবে? কেন যথাযথ ভাবে রায় ঘোষণার আগে তাঁদের বক্তব্য শোনা হলো না? চাকরিহারা শিক্ষকদের তরফে ধৃতীশ মণ্ডলের আক্ষেপ, ‘হাজার হাজার বছরের পুরোনো মন্দির–মসজিদ খুঁজে বের করতে পারেন, আর আমাদের ওএমআর শিট খুঁজে বের করতে পারেন না? তা হলে কীসের ভিত্তিতে আমাদের অপরাধী করে দিলেন?’ গণআত্মহত্যা ও চরমপন্থী আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে এ দিন।