এই সময়: প্রতিবাদ কর্মসূচি ছাপিয়ে গিয়ে বড় হয়ে উঠল দলের এক মহিলা সাংসদের উদ্দেশে সহকর্মী এক তৃণমূল সাংসদের প্রকাশ্যেই করা ‘যৌনগন্ধী কুমন্তব্য’। একবার নয়, বারবার। ঘটনাস্থলে উপস্থিত জোড়াফুলের অন্য সাংসদরাও হতবাক। তাঁদের মধ্যেও একাধিক মহিলা সাংসদ রয়েছেন। কেউ কেউ ওই বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, যাঁকে উদ্দেশ করে এই মন্তব্য, সেই মহিলা সাংসদও স্পষ্ট প্রতিবাদ জানাচ্ছেন- কিন্তু কে শোনে কার কথা। উল্টে সুর আরও চড়ল ওই বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদের।
শুধু প্রকাশ্যে মন্তব্য নয়, তৃণমূল সাংসদদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও ওই মহিলা সাংসদের উদ্দেশে একের পর এক কুমন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। এমনকী, অন্য এক সাংসদ তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করলে উল্টে তাঁকেও অপমান করতে ছাড়েননি তিনি। এই হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথনের কিছু অংশের স্ক্রিনশট ‘এই সময়’-এর কাছেও রয়েছে। সূত্রের দাবি, বিষয়টি এমনই মাত্রাছাড়া জায়গায় পৌঁছেছে যে, একাধিক সাংসদ বিষয়টি কালীঘাটে তৃণমূলের একেবারে শীর্ষ নেতৃত্বের নজরেও এনেছেন। যদিও রবিবার পর্যন্ত ওই বর্ষীয়ান সাংসদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়েছে, এমন খবর নেই। ঠিক কী হয়েছিল?
শুক্রবার ডুপ্লিকেট এপিক ইস্যুতে নির্বাচন কমিশনে প্রতিবাদ কর্মসূচি ছিল তৃণমূল সাংসদদের। সূত্রের দাবি, সেখানে যোগ দেওয়ার আগে সাংসদরা প্রথমে দিল্লিতে সংসদ ভবনে তৃণমূলের পার্টি অফিসে পৌঁছন, সেখান থেকে শুরু হয় মিছিল। ওই মহিলা সাংসদ সেখানে গিয়ে দেখেন, মিছিলে অংশগ্রহণকারী এমপি-দের তরফে যে স্মারকলিপি দেওয়া হবে, তাতে তাঁর নাম নেই। এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই শুরু হয় গোলমাল।
অভিযোগ, ওই বর্ষীয়ান সাংসদ তখনই নিশানা করেন মহিলা সহকর্মীকে। তিনি প্রতিবাদ করলেও বিষয়টি তো থামেইনি, উল্টে নির্বাচন সদন পর্যন্ত মিছিল পৌঁছতে সেখানে আরও বাড়ে এই গোলমাল। যাঁকে ঘিরে কটু মন্তব্য করছিলেন ওই বর্ষীয়ান সাংসদ, সেই মহিলা এমপি-র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। তবে ঘটনাস্থলে থাকা অন্য এক সাংসদের দাবি, ‘নির্বাচন কমিশনে পৌঁছনোর পরেও ওঁকে লক্ষ্য করে যাচ্ছেতাই ভাষায় মন্তব্য করে যাচ্ছিলেন বর্ষীয়ান সাংসদ। তাতে আমার অনেক সহকর্মী তো বটেই, এমনকী নির্বাচন কমিশনের আধিকারিক, সেখানে ডিউটিরত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরাও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। উনি ধাক্কাধাক্কি পর্যন্ত করছিলেন সবার সামনে। ওই মহিলা সাংসদ কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের বলেন ওঁকে সামলাতে।’
সূত্রের দাবি, এর পরে সংসদের মকর দ্বারে প্রতিবাদ চলার সময়েও ওই মহিলা সাংসদকে অশালীন ভাষায় কটাক্ষ করতে ছাড়েননি তিনি। সকালের এই রেশ চলতে থাকে রাতে তৃণমূল সাংসদদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও। এক সাংসদ ওই বর্ষীয়ান এমপি-কে উদ্দেশ করে গ্রুপে লেখেন, ‘টেক হিট ইজ়ি... দিদি সবাইকে নিয়ে চলার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তোমাকে দিয়েছেন। ... অ্যাক্ট লাইক অ্যান অ্যাডাল্ট...।’
তাঁকেও ছাড়েননি ওই বর্ষীয়ান সাংসদ, ঘটনাচক্রে যিনি আবার পেশায় আইনজীবীও। তিনি পাল্টা ওই গ্রুপে লেখেন, ‘ডোন্ট অ্যাডভাইস মি... তুমি বয়সে আমার থেকে ছোট।... আমি ২০১১ থেকে দায়িত্ব সামলাচ্ছি।’ এর মাঝেও আরও বেশ কিছু কথা চালাচালি হয়, যার বিস্তারিত শালীনতা ব্রক্ষার স্বার্থেই প্রকাশ করছে না ‘এই সময়’। বর্ষীয়ান সাংসদটি সেই মেসেজে ওই মহিলা সাংসদকে কটাক্ষ করে ইন্টারন্যাশনাল গ্রেট লেডি’ বলেও উল্লেখ করেছেন। এরপরে যে সাংসদ তাঁকে থামতে বলছিলেন, তিনি নিজেই চুপ করে যান। ক্রমাগত অশালীন মন্তব্যের জেরে শুক্রবার রাতে ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ 'লিভ’ করেন ওই মহিলা সাংসদ।
আবার যে তৎমল সাংসদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠছে, তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, ‘দিল্লির পার্টি অফিসে পৌঁছনোর পরে ওই মহিলা এমপি-ই প্রথমে আমার সঙ্গে অভদ্র আচরণ করেন। অত্যন্ত খারাপ ভাষায় কথা বলেন। এমনকী, আমাদের ডেলিগেশন নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে পৌঁছলে সেখানে ডিউটিরত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের দিয়ে আমাকে এরেস্ট করার ভয় পর্যন্ত দেখান। তখন আমিও রিয়্যাক্ট করেছি।’ বিষয়টি যে প্রকাশ্যেই হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। সংসদের দুই কক্ষে তৃণমূলের অনেক এমপি-ই বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। তা হলে এখনও পর্যন্ত ব্যবস্থা হলো না কেন? কেনই বা প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না ওই মহিলা সাংসদ? কেনই বা পুলিশে নালিশ করেননি?
দলের এক মহিলা সাংসদের কথায়, ‘এই ব্যক্তিটি প্রথমবার এমনটা করলেন, তা নয়। বছর আটেক আগে সংসদের সেন্ট্রাল হলে আর এক প্রবীণ মহিলা সাংসদকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিলেন তিনি। তখনও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা হয়নি।’ তা হলে এখনও চুপ করে থাকবেন? সাংসদের জবাব, ‘এখন মুখ খুললে বা থানায় অভিযোগ করলেই মনে হবে, আমি বা আমরা দলের বিরুদ্ধে কথা বলছি। দিদি (তৃণমূলনেত্রী) নানা কাজে ব্যস্ত। কখনও আরজি কর, কখনও ২৬ হাজারের চাকরি বাতিলের মতো বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। তাঁকে এই সময়ে বিব্রত করা হয়তো মুশকিল। কিন্তু দলের দুই রুক্ষের সংসদীয় নোত্যতাও তো রারস্থা নিতে পারতেন। তাঁরা নিশ্চুপ। ফলে উনি এ ভাবে বারবার একই ঘটনা ঘটাতে পারছেন।’
তৃণমূলের আর এক মহিলা সাংসদের কথায়, ‘যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা, যে রাজ্যের শাসকদলের সুপ্রিমো একজন মহিলা, সেই শাসকদলের একজন মহিলা সাংসদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করা হয় প্রকাশ্যে, এর থেকে বড় লজ্জাজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?’ নাম প্রকাশ না-করার শর্তে লোকসভার এক তৃণমূল সাংসদের বক্তব্য, 'আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। তবে বিষয়টা জানতে পেরেই আমরা কয়েকজন সংসদীয় নেতৃত্বকে বলি পার্টি অফিসে মিটিং ডাকতে। সেটা অবশ্য হয়নি।’
তাঁরও আক্ষেপ, ‘এর আগেও উনি একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। মহিলাদের প্রতি আমরাই সম্মান দেখানোর পরামর্শ দিই, সেখানে একজন বর্ষীয়ান সাংসদ প্রকাশ্যে যে কাজটা করলেন তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।’ সূত্রের খবর, দলের তৃণমূলের মহিলা সাংসদদের একটা বড় অংশ ঠিক করেছেন, যতক্ষণ না ওই বর্ষীয়ান সাংসদের এমন আচরণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং তিনি ক্ষমা না-চাইছেন, ততদিন তাঁকে ‘অলিখিত বয়কট’ করা হবে। তাঁর ডাকা কোনও মিটিং, বাড়িতে কোনও আমন্ত্রণে যাবেন না ওই মহিলা সাংসদরা- এমনটাই সূত্রের খবর। বিষয়টি নিয়ে জানতে তৃণমূলের লোকসভা ও রাজ্যসভার অন্য দুই প্রবীণ নেতার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা হলেও তাঁরা কেউ ফোন ধরেননি, মেয়েদেরও জরার দেননি।