• চাকরি না হারিয়েও পাত্রী হাতছাড়া শিক্ষক পাত্রদের!
    এই সময় | ০৭ এপ্রিল ২০২৫
  • অরূপকুমার পাল, ঝাড়গ্রাম

    সে অনেক কাল আগের কথা। ‘দরিদ্র মাস্টারের’ সঙ্গে বিয়ের পর বহু তরুণীকেই অভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হতো। তাই সৎ পাত্র হলেও মাস্টারের বেতন বিয়ের বাজারে খুব একটা আকর্ষক ছিল না।

    পরে সময় বদলাল। মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের রোজগার বাড়ল। তার উপরে সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা মানে নিশ্চিন্ত থাকা। আর সম্মান তো বরাবরই রয়েছে। মাস্টারের গা থেকে ঘুচল ‘দরিদ্র’ তকমা।

    কিন্তু এখন সময়টা ফের বদলেছে। গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি। এঁদের বড় অংশই শিক্ষক। এবং তাঁরা নাইন থেকে টুয়েলভের মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন। স্কুলে অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ–প্রশ্নে আদালতের নির্দেশে কাজ হারিয়েছেন বহু যোগ্য প্রার্থীও। পরিস্থিতি এমনই যে যাঁদের চাকরি বাতিল হয়নি, বৃহস্পতিবারের রায়ের প্রভাব যাঁদের উপরে পড়েইনি, তাঁদেরও এখন সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। বিয়েও ভাঙছে এঁদের অনেকের। পাত্রীর বাবা–মা পাত্রের পরিবারকে সাফ জানাচ্ছেন, ‘শিক্ষকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবো না!’

    বাস্তবের পাশাপাশি রিল, ভিডিয়ো বানিয়েও মস্করা শুরু হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যা আদতে রুচিহীনতার প্রমাণ বলে মনে করছেন অনেকেই।

    মাস কয়েক আগে কোর্টের রায়ে আপার প্রাইমারিতে (অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত) চাকরি পেয়েছেন ঝাড়গ্রামের এক তরুণ। পরিবার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা শুরু করে। বছর ৩৭–এর ছেলের জন্য পুরুলিয়াতে মেয়ে দেখে পরিবার। দুই ফ্যামিলির সম্মতিতে ঠিক হয়, পাকা কথা হবে কাল, মঙ্গলবার। এরই মধ্যেই সুপ্রিম–নির্দেশের বজ্রাঘাত! যার প্রভাব কোনও ভাবেই পড়েনি ঝাড়গ্রামের ওই তরুণের উপর। তাঁর চাকরি দিব্যি বহাল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! শনিবারই পাত্রীর বাবা ফোনে পাত্রের পরিবারকে জানান, ‘আপনার ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবো না। মঙ্গলবারের পাকা কথাও বাতিল করছি।’

    শিক্ষকের বাবা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ছেলের চাকরি তো বাতিল হয়নি! পাত্রীর পরিবার তবু অনড়। ঝাড়গ্রামেরই প্রাথমিক স্কুলের এক শিক্ষকের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছিল হাওড়ার সাঁকরাইলে। সেখানেও এক ঘটনা। মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলেকে ফোনে বলা হয়েছে, ‘হাই স্কুলের চাকরি বাতিল হয়েছে। শুনলাম, প্রাথমিকের চাকরিও বাতিল হবে। তাই আপাতত বিয়ের কথাবার্তা থাক। পরে না হয় যোগাযোগ করব।’

    এই পরিস্থিতিতে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক আপার প্রাইমারির শিক্ষক বলেন, ‘গত বছর ডিসেম্বরে স্কুলে যোগ দিই। আমাদের তো চাকরি যায়নি। কিন্তু এমনই অবস্থা যে আমাদেরকেও মানুষ সন্দেহ করছেন। খুবই দুর্ভাগ্যজনক!’

    হেনস্থা এখানে থামেনি। ভিডিয়ো এবং রিল সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল, যেখানে শিক্ষক পাত্রদের পাত্রীর পরিবার নানা ভাবে অসম্মান করছে বলে দেখানো হচ্ছে।

    এ সব নিয়ে ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রিস্ট নন্দলাল মাল বলেন, ‘মানুষ সব সময়েই নিরাপত্তা চায়। এই নিরাপত্তার মধ্যে তিনটি বিষয় আছে — চাকরির নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা। বর্তমানে এই জায়গায় একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যা থেকে সমাজে দেখা দিয়েছে এক ধরনের সন্দেহের বাতাবরণ। কর্মহারাদের মধ্যে যোগ্য–অযোগ্য ভাগ করা যায়নি। এবং সে কারণেই সমাজ–ব্যবস্থায় এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে।’

  • Link to this news (এই সময়)